<p>ভূমধ্যসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র রিপাবলিক অব মাল্টা। মাল্টার সবচেয়ে নিকটবর্তী দেশগুলোর মধ্যে আছে ইতালি, লিবিয়া, তিউনিশিয়া। ভৌগোলিকভাবে মাল্টা দক্ষিণ ইউরোপের দেশ এবং দেশটি ২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদ লাভ করে। মাল্টার মোট আয়তন ৩১৬ বর্গকিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখ ১৬ হাজার। তাদের ভেতর ৮৮.৫ ভাগই খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। ইসলাম মাল্টার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। মাল্টার মোট জনসংখ্যার ৩.৯ শতাংশ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও অর্থনীতিতে বেশ সমৃদ্ধ মাল্টা।</p> <p>ধারণা করা হয়, মাল্টায় খ্রিস্টপূর্ব ছয় হাজার বছর আগে মানব বসতি গড়ে ওঠে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মাল্টা সব সময় বিশ্বমোড়লদের আগ্রহের কেন্দ্র ছিল। কালক্রমে মাল্টা শাসন করেছে ফিনিশিয়ান, কার্থাজিনিয়াস, গ্রিক, রোমান, মুসলমান, নরম্যান, অ্যারাগোনিজ, ফরাসি ও ব্রিটিশরা। ১৯৬৪ সালে দেশটি ব্রিটিশদের কাছ থেকেই স্বাধীনতা লাভ করে।</p> <p>মাল্টায় ইসলামের আগমন ঘটে আরব ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলিম বণিকরা মাল্টার নিকটতম ইতালির সিসিলি দ্বীপে যাতায়াত করতেন। সম্ভবত তাদের মাধ্যমেই মাল্টায় ইসলামের আগমন ঘটে। রাজনৈতিকভাবে মাল্টায় ইসলামের আগমন ঘটে উত্তর আফ্রিকার আগলাবি মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে। তারা মূলত আব্বাসীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং উত্তর আফ্রিকায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।</p> <p>মূলত বাইজেন্টাইন শাসকদের আক্রমণ থেকে বাঁচতেই মাল্টা জয় করা অপরিহার্য হয়ে যায়। কেননা বাইজেন্টাইন শাসকরা মাল্টাকে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে একটি সামরিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। মুসলমানরা ২০৯ হিজরিতে মাল্টা জয়ের প্রথম চেষ্টা করে এবং ২৫৫ হিজরিতে তা জয় করতে সক্ষম হয়। তখন ক্ষমতায় ছিলেন আবুল গারানিক মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম। মাল্টার প্রথম অভিযানে নেতৃত্ব দেন সেনাপতি হালাফ বিন হাজিম এবং দ্বিতীয় অভিযানের নেতৃত্ব দেন সাওয়াদা বিন মুহাম্মদ। মুসলমানরা মাল্টা জয় করার পর ২৫৬ হিজরিতে রোমান বাহিনী মাল্টা অবরোধ করে। কিন্তু সিসিলির মুসলিম শাসক মুহাম্মদ বিন খুফাজা বিন সুফিয়ান একটি সাহায্যকারী বাহিনী পাঠালে রোমানরা পালিয়ে যায়। অবশ্য এর পরও একাধিক ইউরোপিয়ান মাল্টা জয়ের চেষ্টা করেছেন।</p> <p>মুসলমানরা মাল্টা জয় করার পর সেখানে ‘রাবাত’ ও ‘মদিনা’ নামের দুটি আধুনিক শহর গড়ে তোলেন। উত্তর মাল্টায় অবস্থিত মদিনা শহরটি ছিল আগলাবিদের রাজধানী। এই শহরের সীমান্তপ্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে আছে। মুসলমানরা এখানে জাহাজশিল্পের গোড়াপত্তন ঘটায়। জাহাজ তৈরিতে পাইনগাছ ব্যবহার করা হতো। মাল্টায় তখন প্রচুর পরিমাণ পাইনগাছ পাওয়া যেত। মুসলিম শাসকরা মাল্টাকে ভূমধ্যসাগরের শক্তিশালী সামরিক নৌঘাঁটিতে পরিণত করেছিলেন, যা সিসিলি, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের মুসলিম শাসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আগলাবিদের পরে ফাতেমিরা উত্তর আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার করলে মাল্টাও তাদের অধীনে চলে যায়। ৪৮৩ হিজরি পর্যন্ত মাল্টায় মুসলিম শাসন টিকে থাকে। এরপর নরম্যানরা মাল্টা দখল করে।</p> <p>২২৮ বছরের মুসলিম শাসনামলে মাল্টার বেশির ভাগ অধিবাসী ইসলাম গ্রহণ করে। তারা সেটা করেছিল মুসলমানের উত্তম আচরণ দেখে। নরম্যানরা মাল্টা দখল করলেও তারা দক্ষ আরব প্রশাসকদের স্বপদে বহাল রাখে এবং খ্রিস্টীয় ১৩ শতক পর্যন্ত মুসলমানরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের সুযোগ পায়। মূলত বার্ষিক কর প্রদানের শর্তে একজন মুসলিম আমির মাল্টা শাসন করতেন। ১১২২ খ্রিস্টাব্দে মাল্টার মুসলিমরা দেশ স্বাধীন করতে নরম্যানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ১১২৭ খ্রিস্টাব্দে সিসিলির শাসক দ্বিতীয় রজার মুসলমানদের পরাজিত করে মাল্টার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১১২৪ খ্রিস্টাব্দে ‘হোলি রোমান অ্যাম্পায়ার’-এর শাসক দ্বিতীয় ফ্রেডরিক মুসলিম জনসংখ্যা হ্রাসের নীতি গ্রহণ করেন। সে সময় বহু মুসলিম দেশত্যাগে বাধ্য হয়।</p> <p>আল্লামা ইবনে খালদুন লেখেন, এ সময় মুসলমানদের জন্য তিনটি পথ খোলা ছিল : ধর্মান্তর, দেশান্তর ও বন্দিত্ব। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয় বাহিনী জয়ের চেষ্টা করে। প্রায় চার মাস অবরোধ করে রাখার পরও তারা মাল্টা জয়ে ব্যর্থ হয়।</p> <p>মুসলমানদের দুই শতকের শাসনামলের প্রভাব এখনো মাল্টার ভাষা ও সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান, বিশেষত মাল্টিজ ভাষার বহু শব্দ আরবি। মাল্টার বেশির ভাগ জায়গার নাম এবং মাল্টিজদের উপনাম আরবি। যেমন : বর্গ, কাসার, সিকসুকি, ফারজিয়া, মিটকালিফ, মিফসুদ, জাময়িত ইত্যাদি। মাল্টার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে মুসলমানরা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তারা নোরিয়া নামের একটি বিশেষ সেচব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল, যা মাল্টায় কৃষি খাতে বিপ্লব নিয়ে এসেছিল।</p> <p>এ ছাড়া তারা সেখানে নতুন নতুন মসলা, ফল ও ফসলের চাষ শুরু করেছিল। যেমন : ডুমুর, বাদাম, সাইট্রাস (মাল্টা) ইত্যাদি। মুসলমানরা সেখানে তুলা চাষ শুরু করেছিল, যা কয়েক শতক পর্যন্ত মাল্টার অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল। মাল্টার প্রাচীন স্থাপনাগুলো এখনো কাঠের মিক্সরাবিজা (পাখির ঘর) ও মাশরাবিয়া (ঝুল বারান্দা) দেখা যায়। এগুলো মূলত মুসলিম শাসনেরই নিদর্শন বহন করে।</p> <p>মাল্টা স্বাধীন হলেও দেশটির প্রশাসনে এখনো ইসলামভীতি প্রবল। ফলে মুসলমানদের ধর্ম পালনের নানা ধরনের বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। সরকার অনুমোদিত দেশটির একমাত্র মসজিদ হলো মারিয়াম আল-বাতুল মসজিদ। ১৯৮৪ সালে এটি লিবিয়ার সাবেক শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি উদ্বোধন করেন। ১৯৭৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইসলামিক কল সোসাইটি ‘ইসলামিক সেন্টার অব পাউলা’ প্রতিষ্ঠা করে। যার অধীনে মারিয়াম আল-বাতুল স্কুল পরিচালিত হয়।</p> <p><em>তথ্যঋণ : দাওয়াহ ডটসেন্টার, ইসলামওয়েব ডটনেট, ইসলামস্টোরি ডটকম ও উইকিপিডিয়া</em></p>