<p>স্বভাবগতভাবে কেউ খুঁতখুঁতে প্রকৃতির, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে বেশি মনোযোগী। খেতে বসার আগে গ্লাস ও প্লেট কয়েকবার পরিষ্কার করে, দরজায় তালা লাগিয়ে বার কয়েক টেনে নিশ্চিত হয়ে নেয় আসলেই তালাটা লেগেছে কি না। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এগুলো। এই বৈশিষ্ট্য নিয়েই দিব্যি সচ্ছন্দে জীবন পার করা যায় পরিবার, সমাজ, কাজ সব কিছু স্বাভাবিক রেখেই। তবে এজাতীয় ব্যাপার যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, দীর্ঘ সময় নষ্ট করে, দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত করে, তখন সেগুলো রোগের পর্যায়ে চলে গেছে কি না তা পর্যালোচনার প্রয়োজন।</p> <p>শুচিবাই শব্দটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। প্রবল শুচিবাইগ্রস্ততাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিস-অর্ডার বা সংক্ষেপে ওসিডি বলা হয়। তবে শুচিবাই বলতে বেশির ভাগ মানুষ যা বোঝে তা ওসিডির অনেক ধরনের একটি মাত্র।</p> <p>লক্ষণ</p> <p>ওসিডিতে আক্রান্ত ব্যক্তি যেসব সমস্যায় ভোগে, সেগুলোকে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—অবসেশন ও কম্পালসন।</p> <p>অবসেশন বলতে বোঝায় একই চিন্তা, ছবি বা তাড়না বারবার মনে ফিরে আসা। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতে পারে যে তার এই চিন্তা বা তাড়না অহেতুক, অতিরিক্ত। না চাইলেও চিন্তাটি তার মনে আসতে থাকে। নিজের মনের চিন্তা হলেও এর ওপর যেন তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে চিন্তা, ছবি বা তাড়নাটি মন থেকে সরাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। চিন্তার কারণে বা চিন্তা সরাতে ব্যর্থতার কারণে তার মধ্যে অস্থিরতা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এই চিন্তা সাধারণত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ময়লা, সন্দেহ, ধর্মীয়, যৌনতা প্রভৃতি বিষয়ক বেশি হয়। কারো কারো মনে নির্দিষ্টসংখ্যকবার গণনা বা নির্দিষ্ট শব্দ বিষয়ক অবসেশনও হয়।</p> <p>অন্যদিকে কম্পালসন বলতে বোঝায় একই কাজ বা আচরণ বারবার করা। সাধারণত একই চিন্তার পুনরাবৃত্তির ফলে রোগী একই কাজ বারবার করতে থাকে। যেমন—কোনো ব্যক্তির মনে হতে থাকে তার হাতে ময়লা লেগে আছে। সে একবার ভালো করে হাত ধুয়ে নিল। কিন্তু মনে ওই চিন্তা বারবার আসতেই থাকল যে তার হাত ময়লা রয়েই গেছে বা পরিষ্কার হয়নি। ফলে সে বারবার হাত ধুতেই থাকল। রোগী যদিও বুঝতে পারে, হাতে আসলে ময়লা নেই, তার পরও ওই চিন্তা বন্ধ করতে পারে না এবং চিন্তার কারণেই আবারও হাত ধুতে হয়। এমনও দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তি খাওয়ার আগে হাত ধুয়েই চলেছে ঘণ্টা ধরে, অন্যদিকে অন্য সবার খাওয়াদাওয়া কিন্তু শেষ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাজনিত অবসেশনের কারণে অনেকের প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা সময়ও লেগে যায় গোসল করতে।</p> <p>ওসিডিতে আক্রান্ত কোনো কোনো রোগীর শুধু অবসেশন থাকে, আবার অনেক রোগীর অবসেশন ও কম্পালসন উভয়টিই থাকে।</p> <p>কারণ </p> <p>ওসিডি রোগটির কোনো নির্দিষ্ট কারণ বলা যায় না। তবে এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামের এক ধরনের রাসায়নিকের তারতম্য দেখা যায়। যাদের বংশে এই রোগের ইতিহাস আছে, তাদের বংশগতি অথবা আক্রান্ত মা-বাবা বা নিকটাত্মীয়কে অনুকরণের মাধ্যমে এই রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া পরিবেশগত নানা আচরণ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, কিছু শারীরিক রোগ, নির্দিষ্ট মাদক প্রভৃতির সঙ্গে এই রোগের সম্পর্ক রয়েছে। মানসিক চাপের কোনো ঘটনা যেমন—পরীক্ষা, চাকরিচ্যুতি, প্রিয় কারো মৃত্যু প্রভৃতির পর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে এই রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।</p> <p>চিকিৎসা</p> <p>ওসিডি একটি দীর্ঘমেয়াদি কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। এ রোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা রয়েছে। রোগের উপসর্গ ও তীব্রতা ভেদে ওষুধ ও সাইকোথেরাপি দুইভাবেই চিকিৎসা করা হয়। অনেক রোগীর জন্য ওষুধ আবার কারো জন্য কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি পদ্ধতিতে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, ওষুধ ও কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি একত্রে প্রয়োগ করলে রোগীর উপকার বেশি হয়।</p> <p>অনেক ক্ষেত্রে রোগী উপসর্গগুলো অন্যের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। তারা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পরামর্শ নিতে যায় না অথবা দ্বিধাবোধ করে। অথচ সময়মতো সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব।</p> <p> </p> <p>লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কমিউনিটি ও সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট</p> <p> </p> <p> </p> <p> </p>