<p>প্রায় ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;/ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ’। সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীব্যাপী এই হিংসা, উন্মত্ততা আর নিষ্ঠুরতা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধজয়ের নেশায় প্রতিদিনই বলি হচ্ছে মানুষ। যে মুহূর্তে পৃথিবীর ৭০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে, ৩৫ কোটি মানুষ বুভুক্ষায় কাতর, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ চিকিৎসার অপরিহার্য সেবা থেকে বঞ্চিত, ১৫০ কোটিরও বেশি মানুষ প্রায় আশ্রয়হীন, সেই পৃথিবীতে এখন লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে যুদ্ধের পেছনে। তথাকথিত সুখ আর উন্নয়নের নামে মানুষ প্রকৃতিকেও করে তুলেছে বিষাক্ত। ভোগের উদগ্র নেশায় পেয়ে বসেছে মানুষকে। কিন্তু মানুষের অসীম এই ভোগের জোগান মাতা ধরিত্রীর দেওয়ার ক্ষমতা আছে কি? এককথায় বলা যায়, নেই। প্রকৃতপক্ষে আমাদেরই কারণে ধরিত্রী মাতা এখন অসুস্থ।</p> <p>বলা হচ্ছে যে মাতা ধরিত্রী এখন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। কথাটি বলেছেন পৃথিবীর আটটি দেশের ২৬ জন বিজ্ঞানী মিলে করা একটি গবেষণাকাজের প্রধান প্রফেসর ক্যাথেরিন রিচার্ডসন। এই গবেষকদলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য প্রফেসর জোহান রকসট্রম, এ বছর (২০২৪) পরিবেশবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার নামে খ্যাত ‘টায়লার পুরস্কার’ পেয়েছেন। গবেষণাকাজটি প্রকাশিত হয় গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে, ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’ জার্নালে। এই গবেষকরা বলছেন, পৃথিবী সুস্থ থাকার জন্য যে ৯টি ‘গ্রহ সীমারেখা’ (প্লানেটারি বাউন্ডারিস) যেভাবে থাকা প্রয়োজন, তা এখন আর নেই। তাঁদের করা হিসাবে ৯টির মধ্যে ছয়টি এরই মধ্যে বিপত্সীমা অতিক্রম করেছে। এগুলো হচ্ছে—<img alt="ধরিত্রী রক্ষায় মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন" height="170" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/22-04-2024/4.jpg" style="float:left" width="321" />জীবজগতের অখণ্ডতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবসৃষ্ট ক্ষতিকর পদার্থগুলোর পরিমাণ বৃদ্ধি, সমুদ্র অম্লতা বেড়ে যাওয়া, ভূমির অবস্থা পরিবর্তন এবং জীব-ভূ-রাসায়নিক প্রবাহ বদলে যাওয়া। বাকি তিনটির (ওজোনস্তর ক্ষয়, মিঠা পানি হ্রাস, বাতাসে ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি) সীমা বিপদরেখা অতিক্রম না করলেও তাদের অবস্থাও ভালো নয়। প্রবন্ধটি প্রকাশের এক দিন পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রফেসর রিচার্ডসন বলেন, ‘... ...এটি স্পষ্ট সতর্কসংকেত। এর সঙ্গে আমরা আমাদের রক্তচাপের তুলনা করতে পারি। রক্তচাপ একশ কুড়ি/আশির বেশি থাকলে তা হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিতভাবে ঘটাবে, সে কথা বলা না গেলেও সেটি যে ঝুঁকি তৈরি করে, তা তো অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং এই চাপ আমাদের কমানো প্রয়োজন। আমাদের নিজেদের জন্য এবং আমাদের সন্তানদের জন্য।’</p> <p>বিজ্ঞানীরা বারবার এ ব্যাপারে সতর্ক করে চলেছেন। বেলজিয়ামভিত্তিক একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (সেন্টার ফর রিসার্চ অন দি এপিডেমিওলজি অ্যান্ড ডিজাস্টার) হিসাব অনুযায়ী গত বছরও (২০২৩) পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, ঝড়, দাবানল, ভূমিকম্প, খরা, ইত্যাদি) সংঘটিত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় এক লাখ মানুষের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১০ কোটি মানুষ। বিগত ২০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত গড় মৃত্যুর তুলনায় এটি ৩৫ শতাংশ বেশি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রধানত মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্যই পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বছর আগে মানুষ যখন যাযাবর জীবন ছেড়ে পৃথিবীর নানা জায়গায় স্থায়ী জীবন শুরু করল, মূলত তখন থেকেই মানুষ কর্তৃক প্রকৃতির ভৌত, রাসায়নিক ও জীবজ অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন প্রকট থেকে প্রকট রূপ ধারণ করেছে। বিগত ৬০ বছরে মানুষ উন্মাদের মতো প্রকৃতি তথা মাতা ধরিত্রী ধ্বংসে উঠেপড়ে লেগেছে। এই উন্মত্ততা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। মানুষের কর্মকাণ্ডে (বায়ু, পানি, মাটি ও অন্যান্য দূষণ) পৃথিবীতে বছরে প্রায় সোয়া এক কোটি মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অন্যান্য জীব প্রজাতিও, যাদের সংবাদ আমরা রাখি না। পৃথিবীর শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আজ সত্যি উদ্বিগ্ন! মাতা ধরিত্রীকে রক্ষায় আমাদের সচেতনতা দরকার।</p> <p>বিশ্বব্যাপী এই জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২০০৯ সালের পয়লা মার্চ প্রতিবছর ২২ এপ্রিল ধরিত্রী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে। এ বছর এই দিবসটির প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘গ্রহ বনাম প্লাস্টিকস’। আসলে প্লাস্টিক এখন পৃথিবীর জন্য ভয়ংকর এক সমস্যা হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে বছরে এখন প্রায় ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক তৈরি করা হচ্ছে। একটি হিসাবে দেখা গেছে যে গত বছর প্রতি মিনিটে এক লাখ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে উৎপাদিত মোট প্লাটিকের অর্ধেক তৈরি হয় মাত্র একবার ব্যবহারের জন্য। প্রসাধন (টুথ পেস্ট, শ্যাম্পু, মেকআপ, ব্রাশ ইত্যাদি), রং (সিনথেটিক) এবং পোশাকশিল্পে (সিনথেটিক কাপড়) ব্যবহূত প্লাস্টিকও পরিবেশদূষণ ঘটাচ্ছে।</p> <p>পৃথিবীর প্রভাবশালী বহু জার্নালে (নেচার, ল্যানসেট, রয়াল সোসাইটি, এলসিভিয়ার ইত্যাদি গ্রুপ) প্লাস্টিক/মাইক্রোপ্লাস্টিক (এক থেকে পাঁচ হাজার মাইক্রোমিলিমিটার দৈর্ঘ্য) দূষণ সম্পর্কে অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। মানুষসহ অন্যান্য জীবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। একাধিক গবেষণায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের সঙ্গে মানবদেহে হরমোন সমস্যা, হার্টের অসুখ, ক্যান্সার থেকে শুরু করে নানা রকম রোগ সৃষ্টির সম্পর্ক পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। মানুষ ছাড়াও প্লাস্টিক/মাইক্রোপ্লাস্টিক অন্যান্য প্রাণী এবং উদ্ভিদের সমস্যা তৈরি করছে। মাটি ও পানির ভৌত বৈশিষ্ট্য নষ্ট করাসহ সেখানে বিষাক্ত রাসায়নিক যোগ করছে প্লাস্টিক। এলসিভিয়ার গ্রুপের একটি জার্নালে এ মাসে (এপ্রিল ২০২৪) প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সমুদ্র তলদেশে ৩০ লাখ থেকে এক কোটি ১০ লাখ টন প্লাস্টিক জমা হয়ে দূষণ ঘটাচ্ছে। প্লাস্টিক তৈরির প্রক্রিয়ায়ও বায়ুদূষণ এবং পানিদূষণ ঘটে থাকে। আসলে প্লাস্টিক প্রস্তুতপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে দূষণ ঘটিয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনই প্লাস্টিক তৈরির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে তা ধরিত্রীর বুকে বিপর্যয় ডেকে আনবে।</p> <p>সে কারণেই এ বছর আন্তর্জাতিক ধরিত্রী দিবসে প্লাস্টিককে প্রতিপাদ্য করে তার মাধ্যমে আগামী দেড় দশকের মধ্যে (২০৪০) পৃথিবীতে প্লাস্টিক উৎপাদন ৬০ শতাংশ কমানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহল আশা করছে যে জনসচেতনতা তৈরি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে (২০৩০) একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করা, প্রসাধন ও পোশাক শিল্পের জন্য প্লাস্টিক নীতমালা তৈরি করা এবং প্লাস্টিকমুক্ত বিশ্ব গড়তে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও উপকরণে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে প্লাস্টিকের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।</p> <p>মাতা ধরিত্রীকে রক্ষা করতে হলে প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ করাসহ পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসকারী সব ধরনের কাজের লাগাম টেনে ধরা দরকার। ব্যক্তি ভবিষ্যতের চেয়ে সম্মিলিত ভবিষ্যেক বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কভিড-১৯ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে কোনো দেশ সম্পদের পাহাড় গড়লেও তা মানুষের বেঁচে থাকার প্রাথমিক সুযোগগুলো সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। উন্নয়নের অগ্রাধিকার হিসেবে মানুষ ও জীবজগতের স্বাস্থ্যকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।</p> <p>ধরিত্রীকে রক্ষা করতে হলে দূষণ সৃৃষ্টিকারী দ্রব্যের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রবিরোধী কৃষি ও উন্নয়ন, অবৈজ্ঞানিকভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, দূষণ সৃষ্টিকারী পদ্ধতিতে শক্তি তৈরি বন্ধ করা দরকার। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বৈষম্য, পিতৃতন্ত্র, অবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ও বন্ধ হওয়া আবশ্যক। প্রকৃতিবান্ধব জীবনদর্শন চর্চা ও অনুসরণ করা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, পরিবেশ-প্রকৃতি পরিবর্তন বন্ধ করার জন্য ‘পদ্ধতি পরিবর্তন’ প্রয়োজন। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন।</p> <p>উপরোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে বাংলাদেশকেও কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে দূষণ (প্লাস্টিকসহ), বাস্তুতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, অবৈজ্ঞানিকভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, বৈষম্য, অবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণে কাজ করা দরকার। তবে এসব কাজ বিজ্ঞানসম্মতভাবে করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনা ও নিবিড় গবেষণা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থায়ী ও শক্তিশালী গবেষকদল ছাড়া এ কাজে সফলতার আশা করা দুরাশা মাত্র। সাময়িক প্রকল্প করে এ কাজ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ ও প্রকৃতি ভালো রাখতে পারলে তা মাতা ধরিত্রীর জন্য কতটুকু তাৎপর্য বহন করবে, সেই হিসাবে না গিয়ে বলা যায় যে এগুলো করা সম্ভব হলে তা বাংলাদেশের মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।</p> <p>লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক</p> <p>রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p>