<p>সাম্প্রতিক সময়ে দুটি বড় আন্দোলন সরকারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। এর মধ্যে একটি কোটা সংস্কার আন্দোলন, অন্যটি নিরাপদ সড়কব্যবস্থার দাবিতে কিশোরদের আন্দোলন। সর্বাত্মক আন্দোলন বলতে যা বোঝায়, তার অন্যতম দৃষ্টান্ত এই দুটি আন্দোলন। এর আগে বাংলাদেশে এ রকম কোনো কিশোর আন্দোলন ঘটেনি। কিশোররাও যে সংগঠিত হতে পারে, তা সর্বশেষ নিরাপদ সড়কব্যবস্থার দাবির আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে। তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এরই মধ্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। বেশ কয়েকটি বাস্তবায়নও হয়েছে। আরো কয়েকটি বাস্তবায়নাধীন। তবে মন্ত্রীর পদত্যাগসহ কিশোরদের কয়েকটি দাবি অনেকটা উপেক্ষিত থেকে গেছে। অথচ কিশোরদের দাবিগুলোর মধ্যে দ্রুততম সময়ে মেনে নেওয়া সহজ ছিল মন্ত্রীর পদত্যাগ। হয়তো আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের খুব বেশি সময় বাকি নেই বিধায় মন্ত্রীর পদত্যাগ হয়নি। কারণ এর জন্য সরকারের ভাবমূর্তি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে কিংবা সড়ক পরিবহন শ্রমিক নেতা হওয়ায় মন্ত্রী একধরনের জিম্মিব্যবস্থার মাধ্যমে হুমকির মধ্যে রেখেছে সরকারকে। অবশ্য এমন হুমকির ভয় যদি সরকারব্যবস্থা পেয়ে যায়, তাহলে দেশের সাধারণ জনগণও ওই মন্ত্রীর কাছে অনেকটা জিম্মি। কারণ পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি না চালালে সাধারণ মানুষ চলবে কিভাবে—সেটি একটি বড় প্রশ্ন।</p> <p>সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত দুটি আন্দোলন সরকারকে নানাবিধ কৌশলের আশ্রয় নিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছে। প্রথমে কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে আন্দোলনকারীরা যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণায় আনন্দ মিছিল করেছিল, ঠিক সেভাবে পরবর্তী সময়ে দুটি আন্দোলনের কোনোটিই আনন্দ মিছিল করে শেষ হয়নি। অনেকটা ক্ষোভ, দুঃখ কিংবা কষ্ট নিয়ে আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি শেষ করতে হয়েছে। তবে গত ১২ আগস্ট ব্যাপক সমালোচনার মুখে কোটা সংস্কারসংক্রান্ত সচিব কমিটির জন্য নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই সরকার কোটা থেকে সরে আসার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোটা বিষয়ে সরকারের আগের কঠোর অবস্থান পাল্টানোর এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন কোটা সংস্কারসংক্রান্ত সচিব কমিটির একজন সদস্য। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার, বাতিল ও পর্যালোচনার লক্ষ্যে গঠিত সরকারি কমিটির প্রাথমিক সুপারিশ হলো কোটা প্রায় পুরোটাই উঠিয়ে দেওয়া। অবশ্য এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ রাখার বাধ্যবাধকতা নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কাছে মতামত জানতে চেয়েছে কমিটি। ১৭ আগস্ট অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘দু-তিন দিন আগে এ ব্যাপারে চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আমার মতামত চাওয়া হয়েছে। আগামী সোমবারের মধ্যে আমার মতামত দেব।’ </p> <p>আগামী অক্টোবরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল হতে যাচ্ছে। আর এই মুহূর্তে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলন কিছুটা কৌশল এবং কিছুটা বলপ্রয়োগের ভিত্তিতে সরকারকে দমন করতে হয়েছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা যাচ্ছে। এমনকি এ দুটি আন্দোলনই দমন করতে ছাত্রলীগকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হয়েছে। ছাত্রলীগের ভূমিকা নিয়ে গণমাধ্যমসহ সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি মিশ্র এবং অনেকাংশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিশেষ করে যারা সাধারণ এবং সচেতন নাগরিক, তাদের এ বিষয়ে নেতিবাচক মতামত স্পষ্ট হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী ডিসেম্বর মাসে একাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাঝখানে মাত্র চার মাস সময় রয়েছে। এর মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ভোটারদের নিজেদের পক্ষে রাখার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।</p> <p>আওয়ামী লীগের যেমন ভোটারদের সমর্থন প্রয়োজন, তেমনি অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও। এ কারণে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত দুটি আন্দোলনকেই তাদের বিশেষ ট্রাম্পকার্ড মনে করেছে। তারা মনে করেছে, একদিকে তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, অন্যদিকে সরকার পতনের ইস্যু এই আন্দোলন দুটি। কারণ তাদের (বিএনপি-জামায়াত) পক্ষ থেকে বিগত সাড়ে চার বছরে কোনো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা সম্ভব হয়নি। ফলে আন্দোলন দুটিতে তাদের (বিএনপি-জামায়াত) বিশেষ উৎসাহ লক্ষ করা গেছে।</p> <p>কোটা সংস্কার আন্দোলনের দু-একজন নেতার সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে তাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছি। তারা মনে করে, তাদের আন্দোলন থেকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে ফিডব্যাক পেয়েছিল, সেটি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে যে গড়িমসি হয়েছে, সেটি মূলত বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে আন্দোলনে উসকানি দেওয়ার কারণে। এমনকি শান্তিপূর্ণ কিশোর আন্দোলনকেও অন্যদিকে প্রবাহিত করার পেছনে উসকানি দিয়েছেন বিএনপির কিছু নেতা। যার দু-একটি ফোনালাপের কথোপকথন গণমাধ্যম সূত্রে আমরা শুনতে পেয়েছি। ফলে কিশোর আন্দোলনটিও ইতিবাচক রূপ নিয়ে শেষ হতে পারেনি।</p> <p>তবে যে কারণেই এবং যেভাবেই এই আন্দোলন দমিয়ে রাখা হোক না কেন, কিছু কিছু প্রশ্নে সাধারণ জনগণ এবং তরুণদের মন ভেঙেছে। অনেক কিছুই সংঘটিত হয়েছে, যেগুলো গুজব কিংবা অসত্য। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তরুণরা মনে করেছে, যেগুলো প্রচারিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, সেগুলোর অনেক কিছুই হয়তো সত্য আবার মিথ্যাও বটে। এমন বিশ্বাস জনগণের একটি অংশও করছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের যদি প্রশ্ন করি, কে কে কোটা সংস্কারের পক্ষে—এ ক্ষেত্রে দেখা যায় ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই হাত তুলে তার পক্ষে সমর্থন দেয়। এমনকি নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে সাধারণ জনগণও সোচ্চার।</p> <p>কোটা বাতিল হবে না সংস্কার হবে, সে বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানলে কোটা বাতিল করা সম্ভব না এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে কোনো আপস করার সুযোগ নেই। এর ফলে কোটা সংস্কার প্রশ্নে যারা একমত তাদের মনে একধরনের ক্ষোভ থেকেই গেছে।</p> <p>কিন্তু এই ক্ষোভ কিংবা চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটার ফ্যাক্টর প্রশ্নটি কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? অনেকেরই ধারণা, আগামী একাদশ নির্বাচনে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে প্রায় আড়াই কোটি তরুণ ভোটার। বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে হওয়া এই দুই কোটি ৩০ লাখ ভোটারই আগামী নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। ১৮ থেকে ২৮ বছরের এসব ভোটারের সমর্থনেই ঠিক হবে ক্ষমতায় বসবে কোন দল। তরুণ এসব ভোটারের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ যে ভোটের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব রাখবে, তা জানে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলই। সর্বশেষ নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আগের সব হিসাব-নিকাশকেই পাল্টে দিয়েছে। নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তরুণদের প্রত্যাশাগুলো নিয়েও চিন্তা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অন্দরমহলে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরিকল্পনাও শুরু করেছে তরুণদের আকৃষ্ট করার, আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নানা বিষয় সামনে এনে তরুণ ভোটারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে বিএনপি। বিএনপি ধরেই নিয়েছে যে সাম্প্রতিক যে আন্দোলন দুটি যথার্থভাবে ফলাফল আনতে পারেনি, সেই দুটি আন্দোলনও তাদের ভোটের পুঁজিতে সহায়তা করেছে। তরুণদের কাছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, নিরাপদ সড়ক, সমাবেশের অধিকারও যে প্রাধান্য পাচ্ছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলো। তাই আগামী নির্বাচনে নিরাপদ সড়ক এবং কোটাপদ্ধতির সংস্কার প্রশ্নে তরুণ ভোটার ইস্যু কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।</p> <p><strong>লেখক :</strong> সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p>