<p>পৃথিবীর বহু দেশেই উন্নয়নের প্রথম সোপান হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা এসএমইকে বিবেচনা করা হয়। চীন-জাপানের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসএমইর অবদানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনীতি দারিদ্র্যের চিরন্তন অপবাদ ঘুচিয়ে যখন উন্নয়নের দিগন্তে পাখা মেলতে শুরু করে, তখন থেকেই সরকার এসএমই খাতের উন্নয়নকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আসছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের যুক্ত করার প্রয়াস চালু হয়েছে। এর ফলে এগিয়ে এসেছেন অনেক এসএমই উদ্যোক্তা, সুযোগ পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা।</p> <p>এসএমই খাতকে চিহ্নিত করে একে গুরুত্ব দেওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। একজন উদ্যোক্তা যদি একটি ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা দিয়ে জীবন শুরু করেন, তাহলে তাঁদের ১০ শতাংশ হলেও বৃহৎ ও মাঝারি উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু নতুন প্রজন্মের মানুষদের দ্বারা সৃষ্ট, সুতরাং নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষণ প্রধানত সরকারেরই দায়িত্ব। এসএমই খাত বলতে কী বোঝাবে এর সংজ্ঞায়ন নিয়ে দীর্ঘদিন একধরনের জটিলতা ছিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা প্রদান করেছে। এই খাতে অর্থায়নের জন্য শেষ অবধি বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের ২০১০ সালের শিল্পনীতিতে প্রদত্ত সংজ্ঞাকে গ্রহণ করেছে। কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বলতে কোন ধরনের শিল্পকে বোঝাবে, তা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর একটি নির্দেশনা জারি করেছে। সে অনুসারে ১০ লাখ টাকা মূলধন ও ১৫ জনের কম কর্মচারী নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠানকে বলা হবে কুটিরশিল্প। আবার ১০ লাখ থেকে শুরু করে ৭৫ লাখ টাকা মূলধন ও কর্মচারী ১৬ থেকে ৩০ জন হলে একে ধরা হবে ‘মাইক্রো’ শিল্প। ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান হলে ৭৫ লাখ থেকে ১৫ কোটি এবং সেবামুখী প্রতিষ্ঠানের বেলায় ১০ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা মূলধন হতে হবে। কর্মচারী হবে যথাক্রমে ৩১ থেকে ১২০ জন এবং ১৬ থেকে ৫০ জন। আর শিল্প-কারখানাটিকে মাঝারি শিল্পের আওতায় নেওয়া হবে, যদি এর মূলধন উৎপাদন খাতের বেলায় ১৫ থেকে ৫০ কোটি ও কর্মচারী ১২১ থেকে ৩০০ জন হয়। এ ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মূলধন হতে হবে দুই কোটি থেকে ৩০ কোটি এবং কর্মচারীর সংখ্যা হতে হবে ৫১ থেকে ১২০।</p> <p>ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এসএমই খাতকে অগ্রাধিকার খাত বলে ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিয়েছে যে কুটিরশিল্প, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ, নারী উদ্যোগ, গ্রামীণ উদ্যোগ, ক্লাস্টারভিত্তিক উদ্যোগ, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, শ্রমঘন ও উৎপাদনমুখী উদ্যোগ, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন, রপ্তানিমুখী উদ্যোগ, উদ্ভাবনী নতুন উদ্যোগ, আইটি ও প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগে পর্যায়ক্রমে অর্থায়ন বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকের মোট ঋণ খাতের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এসএমই খাতে হতে হবে। এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আরএসএমই ঋণের ১০ শতাংশ বিতরণ করতে হবে নারী উদ্যোক্তাদের অনুকূলে।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের এই অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতে ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত বিবরণী দাখিল করতে হয়। উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই মেলা ও নারী উদ্যোক্তা মেলার আয়োজন করেছে। অর্থবহ ও আকর্ষণীয় করার জন্য এগুলো জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজন করা হতো এবং প্রায় প্রতিটি মেলায় সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান উপস্থিত থাকতেন।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের এই আগ্রহ দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবায়ন করেছে। ২০১০ সালে এসএমই খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা, যা প্রতিবছরই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক হারে এগিয়ে ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪১ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকায়। এসব ঋণ সেবা, ব্যবসা ও উৎপাদন খাতে বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণকৃত ঋণের বিবরণী খতিয়ে দেখলে এটা স্পষ্ট হবে যে সেবা ও উৎপাদন খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অন্যদিকে এই অগ্রগতি মূলত ব্যবসা খাতে। অর্থাৎ এসএমই খাতের বড় একটা অংশের উদ্যোক্তারা এক বাজার থেকে পণ্য কিনে অন্য বাজারে বা নিজের দোকানে বসে বিক্রি করতেই বেশি আগ্রহী।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে এসএমই ব্যাংকিং ও এসএমই অর্থায়ন একটি নতুন ধারণা, যা ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাদের কাছে সুপরিচিত নয়। সুতরাং ব্যাংক কর্মকর্তাদের এসএমই ব্যাংকিং বিষয়ে সচেতন ও দক্ষ করে তোলার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমনকি এসএমই গ্রাহকদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।</p> <p>এবার আসা যাক এসএমই ঋণ আদায়ের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে। ২০১১ সালে এ ধরনের ঋণ আদায়ের হার ছিল ৭০.৪১ শতাংশ। মাত্র এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকেই এই ঋণ আদায়ের হার কমতে শুরু করে এবং ২০১৬ সালে এসে দাঁড়ায় ৫৮.১৫ শতাংশে। এই শ্রেণীকৃত ঋণের হার আশঙ্কাজনকভাবে আরো বেড়ে চলেছে। ২০১১ সালে শ্রেণীকৃত ঋণের হার ছিল ৩.৮৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে এসে এই হার দাঁড়িয়েছে ১৩.৩৭ শতাংশে। ২০১৭ সালের শুরুতে এই অনাদায়ের হার আরো বেড়ে প্রথম ত্রৈমাসিকেই দাঁড়িয়েছে ১৫.১৫ শতাংশে। অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ এভাবে বাড়তে থাকলে অগ্রাধিকারভিত্তিক আকর্ষণীয় বিনিয়োগের এই খাতটি একসময় গলার কাঁটায় পরিণত হতে পারে। সুতরাং এখনই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যত্নবান হতে হবে।</p> <p>নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককেও পূর্ণ উদ্যম নিয়েই এসব অগ্রাধিকার খাতকে লালন করতে হবে। ঋণপ্রবাহ দেশের প্রত্যন্ত ও সম্ভাবনাময় অঞ্চলে ও খাতে সহজতর করে তার বাস্তবায়নকে দৃষ্টিসীমায় রাখতে হবে। আর সফল ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদানও হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত একটি কাজ। তাহলেই এসএমই খাত সফলতার মুখ দেখবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।</p> <p><strong>লেখক : </strong>সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক</p> <p>itismahfuz@gmail.com</p>