<p>১৯৭০ সালে যখন নির্বাচন হলো তখন আমি লাহোর ক্যান্টনমেন্টে আছি। নির্বাচনী রেজাল্ট পেয়ে তো আমরা খুশি। তারা বিমর্ষ। অনেক কথা আমরা আড়ালে-আবডালে শুনেছি। তাদের কথা শুনে আমরা বুঝতে পেরেছি, তারা আমাদের নির্বাচিত লোকের (বঙ্গবন্ধু) হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। আমার সিনিয়র, মেজর আনোয়ার ভাইকে বললাম, তাহলে তো পূর্ব পাকিস্তানে রক্তবন্যা বয়ে যাবে। হ্যাঁ যাবে। যা হোক, আমি চেষ্টা করে আমার বদলিটা নিয়ে নিলাম। আমাকে কোথাও পোস্টিং দিতে পারল না। পরে চুয়াডাঙ্গার চার নম্বর উইং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলে (ইপিআই) আমাকে পদায়ন করল। আমি একজন অবাঙালির (পাকিস্তানি) কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিলাম। পরে সেখান থেকে আড়াই দিন কাজের প্রয়োজনে চলে গেলাম কুষ্টিয়ায়। সার্কিট হাউসে দুপুরের খাবার রাত ৮টায় খেলাম। ২৫ মার্চ আমার বিবাহবার্ষিকী ছিল। স্ত্রী বলল, আমরা তো বুড়ো হয়ে গেছি, অনুষ্ঠান পরে করব। কাজটা শেষ করো। ২৬ মার্চ সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, পাকিস্তানি আর্মিতে রাস্তা ভরে গেছে। তারা কারফিউ ডিক্লেয়ার করছে। আমি দ্রুত রুমে ঢুকলাম। টেলিফোন করতে চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে লাইন কাটা হয়ে গেছে। তারা কারফিউ ডিক্লেয়ার করতে করতে চলে গেল। আমি রওনা হলাম ঝিনাইদহের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে দেখি, প্রচুর মানুষের সমাগম। এরই মধ্যে সবখানে রটে গেছে আমি নাকি প্রথম বাঙালি কমান্ডার ফর উইং ইপিআরের ইতিহাসে। আমি জরুরি সভায় উপস্থিত সবাইকে ডাকলাম, ভাইসব এখানে আসুন। শুদ্ধ বাংলা শুনে উপস্থিত সবাই বুঝে গেছে, আমি বাঙালি। পরে তাদের আমি আমার পরিচয় দিই। আমি তাদের বললাম, সময় খুব কম। যদি এদের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র ধরতে হয় তোমরা কি আমার সঙ্গে থাকবে? তারা জয় বাংলা বলে উত্তর দিয়েছে। জয় বাংলা ধ্বনিতে চতুর্দিক কাঁপিয়ে দিয়েছে তারা। ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে সাধারণ মানুষ ও আমার অধীনস্থদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলি। জয় বাংলা বলে যে সাড়া তারা দিয়েছিল, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। ৭ই মার্চের ভাষণ আমি শুনতে পারিনি। রাতে বলা হলো, সকালে আবার ভাষণ প্রচারিত হবে। সকালে আমরা রেকর্ডিং করে নিলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। তার পরই সে ভাষণ শুনেছি। ভাষণের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শুনেছি। শোনার পর দেখলাম, ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা, কিভাবে যুদ্ধ করব, কতক্ষণ এবং কিভাবে আমরা যুদ্ধ করব তাও আছে। এরপর চিন্তিত না হয়ে যশোরের টাউন হলে রাজনীতিবিদ, আনসার ভিডিপির প্রধান, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, শিক্ষক, সচেতন মহল—সবাইকে ডাকলাম। কী করতে চাই সে ব্যাপারে কথা বলতে টাউন হলে এক হই। সবাই জানে, আমাদের অস্ত্রবল নেই, প্রশিক্ষিত জনবল নেই, শিক্ষিত সৈন্য নেই, কিন্তু আমাদের মনোবল ছিল অদমনীয়। এতদসত্ত্বেও যখন আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই। অবস্থা এ রকম যে তারা আমাদের বুটের নিচে রেখে আরো সময় নিতে চায়। আরো যত বছর তারা শোষণ করতে পারে। ২২ বছর নিল, আরো নিতে চায়। আপনারা কী এটা চান। তারা জবাব দিল—না। সবাই জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে উত্তর দেয়। তাহলে এমনও তো হতে পারে, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাব। আমাদের সঙ্গে আপনারাও মারা যেতে পারেন। এতে আপনারা রাজি আছেন? তারা জয় বাংলা বলে কাঁপিয়ে দিল। সে যে কী মুহূর্ত তা আপনাদের বোঝাতে পারব না। এ সময়ের গভীরতা বিস্ফোরণ মুহূর্ত, না দেখলে বোঝা যায় না। আমি যতই গলা ফাটিয়ে বলি, কিন্তু আপনারা বুঝতে পারবেন না। যদি আপনারা সরেজমিনে না দেখেন। এ মুহূর্তের অনুভূতি বোঝানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত মিটিং করলাম, বিছানায় শরীর লাগালাম কিন্তু ঘুম হলো না। শোয়া থেকে উঠে গেলাম। সকাল হলো। যোগাযোগ করে সবাইকে বললাম, আমার পরের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করো। তারপর তো কত কত স্মৃতি। কত রক্ত। কত বিসর্জন। কত আত্মত্যাগ। তার পরই তো ১৬ ডিসেম্বর এলো। লাল-সবুজ পতাকাটা আমাদের হলো। এসব কথা কী লিখে শেষ হওয়ার মতো।</p> <p>দুই.</p> <p>যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে। খুব কঠিনভাবে তাদের সাজা দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু জামায়াতের রাজনীতি ১৯৭৩ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও ওই ঘোষণাপত্র বাতিল করে তাদের আবার মাঠে নামান জিয়াউর রহমান। যুদ্ধাপরাধীরা যুদ্ধের সময় লুটপাট করেও আমাদেরই কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় পুনর্বাসিত হয়েছে। সরকারের কাছ থেকেও তারা সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, এ সুযোগে সব দিক দিয়েই তারা নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে।</p> <p>দেশ নিয়ে স্বপ্ন তো নতুন কিছু নয়। প্রথম স্বপ্ন ছিল স্বাধীন হতে হবে। আমাদের অর্জন আমরাই ভোগ করব। তারা (পাকিস্তানি) নেবে কেন? এসব পরিস্থিতি আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমাদের অর্জিত টাকা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাচ্ছি। কেউ হয়তো সেখান থেকে কিছুটা পকেটে ঢুকাচ্ছে। এমনটা হতেই পারে। এটা খুব বড় কোনো সমস্যা নয়। বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, আমি সোনার দেশ গড়তে চাই। আমরা যদি দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে পারি, তবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া সম্ভব। যদি দেশের শীর্ষ ব্যক্তি ইচ্ছা করেন, তাহলে তাঁর অধীনস্থদের ঠিক করতে পারবেন। ধরুন, একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যদি ঠিক থাকেন, তবে তাঁর অধীনস্থ ব্যক্তিদের তিনি ঠিক রাখতে পারবেন। এভাবে ওপর লেভেল থেকে সব ঠিক করতে হবে। নিচের লেভেল থেকে ঠিক করা সম্ভব নয়। তবে নিচ থেকেও ঠিক করা যাবে, যদি তাঁর মা-বাবা নৈতিক শিক্ষা দেন। শিশুদের দেশপ্রেম কী জিনিস, দেশের প্রতি মায়া শেখাতে হবে। সে শিক্ষা দেওয়া স্কুলে কিংবা পরিবারেই সম্ভব। তাহলে বাংলাদেশ সুন্দর হবে, বাংলাদেশ বিশ্বের অহংকার হবে।</p> <p> </p> <p> </p> <p>লেখক : মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার</p> <p>অনুলিখন : কাদের পলাশ</p>