<p>শিরোনাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে কত হতাশ মানুষটি। যদি তিন বেলা খাওয়ার মতো সংগতি না থাকে তাহলে খেলার গৌরবের স্মৃতি এভাবেই অর্থহীন হয়ে যায় তাঁর কাছে। আর তাই কিংবদন্তি ভলিবল খেলোয়াড় নিখিল পালের সাক্ষাৎকারটা হয়ে ওঠে এক বিষাক্ত বেদনার কাব্য। এই কাহিনি শোনাটাই ছিল একটা হৃদয়বিদারক কাজ। নোমান মোহাম্মদ তা করলেন বিষণ্ন মনে।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2017/Print-2017/July/21-07-2017/mmm/kalerkantho-10-2017-07-21-03a.jpg" style="height:138px; width:400px" /></p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> সার্টিফিকেটে আপনার পুরো নাম দেখি উপেন্দ্র নারায়ণ পাল (নিখিল)!</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ও নামে আমাকে কেউ চিনবে না দাদা। সবার কাছে আমি নিখিল পাল।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> আপনার উচ্চতাও তো দেখছি ভলিবল খেলোয়াড়দের জন্য আদর্শ...</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> খেলোয়াড়ি জীবনে আরো বেশি ছিল—৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। বঙ্গবন্ধুও আমার উচ্চতা দেখে খুশি হন খুব। রাশিয়ার তাসখন্দ ডায়নামো বলে একটি দল আসে বাংলাদেশ সফরে। ওদের সঙ্গে খেলার আগের দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমি হাত মেলাতে গেলে উনি বলেন, ‘তুই তো খুব লম্বা, কোথায় চাকরি করিস?’ বললাম, ‘বিটিএমসিতে’। বঙ্গবন্ধু খুব আশীর্বাদ করলেন। বললেন, ‘ভলিবল খেলায় তুই ভালো করবি।’ এখন বয়স হয়ে গেছে; অভাব-অনটনে, না খেয়েদেয়ে উচ্চতা কমে গেছে। মনে হয় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি আছি। ওজন ছিল দুই মণ ১০-১৫ কেজি। এখন পৌনে দুই মণ হয় কিনা সন্দেহ।</p> <p><strong><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2017/Print-2017/July/21-07-2017/mmm/kalerkantho-10-2017-07-21-03b.jpg" style="float:left; height:1054px; width:367px" />প্রশ্ন :</strong> নিদারুণ শারীরিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে আছেন জানি। সেগুলো শুনব। তার আগে আপনার ভলিবল-জীবনের কীর্তির কথা জানতে চাই। আপনার খেলার শক্তিশালী দিক ছিল কোনটি?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> স্ম্যাশিং সবচেয়ে ভালো। এমন চাপ মারতাম, ঠেকাতে গেলে খবর হয়ে যেত। এখানো বিভিন্ন দলের ডিফেন্সের খেলোয়াড়রা বলেন, ‘তোর চাপ ঠেকাতে গিয়ে এমন অবস্থা, মাটি মনে হয় সরে গিয়েছিল।’ আমার চেয়ে ভালো অ্যাটাকার কেউ ছিল না।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> ইয়াদ আলী?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ও তো আমার পরের খেলোয়াড়, আমাকে ‘গুরু’ বলে ডাকে। হ্যাঁ, ও-ও খুব ভালো খেলোয়াড়। বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে ইয়াদ আলী ও নিখিল পালের কথা সবাইকে বলতে হবে। এক ইয়াদ আলী ছাড়া আর কেউ আমার চেয়ে ভালো ছিল—তা মনে হয় না।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> ১৯৭৪-৭৫ সালে রাশিয়ার তাসখন্দ ডায়নামো নামে একটি দল আসে বাংলাদেশ সফরে। সেই দলের কোচ নাকি আপনাকে সে দেশে নিয়ে যেতে চায়?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> দোভাষীর কাছ থেকে তেমনটাই শুনেছি। আমার খেলা ওনার পছন্দ হয় খুব। আমি স্ম্যাশ করি, ওই কোচ বুড়ো আঙুল তোলেন; ভালো একটা ব্লক করলেও দেখান বুড়ো আঙুল। আমাদের কাছে তখন এর মানে তো খারাপ। কিন্তু দোভাষী বুঝিয়ে বলেন, ওরা নাকি খুশি হলে অমন বুড়ো আঙুল দেখায়। খেলা শেষে তাসখন্দ ডায়নামোর কোচ আমাকে জড়িয়ে ধরেন। গর্ব হয় খুব। উনি আমাকে বলেন, ওদের দেশে নিয়ে ভালো প্রশিক্ষণ দেবে। কিন্তু আমি তো তখন দেশেই বাহবা পাই, বিদেশে যাব কেন! তা-ও হয়তো যেতাম। আমাদের পুরো দলের রাশিয়া সফরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর ওসব কিছু আর হয়নি।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> দেশে বাহবা পাওয়া তুমুল জনপ্রিয় সেই ভলিবল খেলোয়াড় এখন দিন কাটাচ্ছেন খুব কষ্টে। শারীরিক নানা সমস্যা, সঙ্গে অর্থনৈতিক টানাটানি। দুঃখ তো নিশ্চয়ই হয়, রাগ হয় না?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> হয়, খুব রাগ হয়। এই যে কিছু দিন আগে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের দিলু খন্দকার ভাই আমার টাঙ্গাইলের বাসায় ওনার রিপোর্টার-ক্যামেরাম্যান পাঠান। সেখানে আমার বাড়িঘরের ছবি তুলে এনেছেন। এই দেখুন পেনড্রাইভে করে সেই রিপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি। ওখানে দেখেন, আমার ঘরভর্তি অনেক মেডেল, অনেক ট্রফি। কত কত ব্লেজার আছে! কিন্তু ওসব দিয়ে তো পেট ভরে না। আমার মাঝেমধ্যে কী ইচ্ছে করে, জানেন? ওই মেডেল, ট্রফি সব কোনো সংবাদপত্র অফিসে এনে পুড়িয়ে দিতে। যে জিনিস আমার পেটে ভাত দিতে পারে না, সেগুলো রেখে কী লাভ! আর এমনিতেও তো মনে হয়, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> কেন, এমনভাবে বলছেন কেন?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> কেন বলব না। আমার দুঃখের কথা শুনলে গাছের পাতাও কাঁদবে। শরীরে পেসমেকার বসানো হয় ২০১২ সালে। পাঁচ বছর পর তা বদলানোর কথা। সামনের অক্টোবরে বদলাতে হবে। কিন্তু টাকা কই! মনে হয় না পেসমেকার বদলাতে পারব। বেশি দিনও তাই বাঁচব না। অবশ্য ডাক্তার তো সেই পাঁচ বছর আগেই একবার বলেছিলেন, আমি মারা গেছি।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> মানে!</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> আমার হার্টে আগেই দুটো ব্লক ছিল। থাকি তো টাঙ্গাইলে। সেখান থেকে ময়মনসিংহে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম ২০১২ সালে। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিলাম। সামনে ড্রেন, সেখানে থুতু ফেলছি। হঠাৎ কী হলো, বুঝিনি। মাথা ঘুরে পড়ে যাই ড্রেনে। মুখ-শরীর সব ড্রেনের মধ্যে, কেবল পা বেরিয়ে। তা দেখে বেশ কিছুক্ষণ পর নাকি লোকজন আমাকে উদ্ধার করে। নিয়ে যায় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। ওখানে ডাক্তাররা বলে দেন, ‘রোগী নিয়ে যান। উনি মারা গেছেন।’</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> বলেন কী!</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> সত্যিই তাই। বাড়িতে খবর যায়। ভাতিজারা খড়ি-লাকড়ি কাটা শুরু করে; ধর্মমতে আমাকে পোড়ানোর জন্য। ঢাকাতেও খবর আসে। এই যে ইব্রাহিম (পাশে বসা বন্ধুকে দেখিয়ে), ও খবর পেয়ে আমাদের সময়ের আরো কয়েকজন ভলিবল খেলোয়াড়কে জানায় মৃত্যুর খবর। কিন্তু ডাক্তার ‘মৃত’ ঘোষণা করার ১৫-২০ মিনিট পর আমার বউ বোঝে যে, শরীরে প্রাণ আছে। ডাক্তারদের জোর দিয়ে বলাতে তারা বুকে চাপ দিয়ে-টিয়ে শ্বাস ফেরায়। পাঠিয়ে দেয় ঢাকা।</p> <p><strong><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2017/Print-2017/July/21-07-2017/mmm/kalerkantho-10-2017-07-21-03c.jpg" style="float:right; height:816px; width:400px" />প্রশ্ন :</strong> পেসমেকার কি ঢাকাতেই লাগানো হয়?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ময়মনসিংহ থেকে আনা হয় ঢাকার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। এই বন্ধু ইব্রাহিম এবং আরো কয়েকজন মিলে নিজেদের যা ছিল, দিয়েছে। সঙ্গে অনেকের কাছে চেয়ে-চিন্তে জোগাড় করে আমার পেসমেকার বসানোর টাকা। তখনই লাগে তিন লাখ টাকার বেশি। এখন তা বদলাতে গেলে এর চেয়ে কমে তো হবে না; বরং হয়তো বেশি লাগবে। তা এত টাকা আমি পাব কই? তিন বেলা ঠিকমতো খেতেই পারি না!</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> এত খারাপ অবস্থা!</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> হ্যাঁ। একসময় আমার ১৫ বিঘা জমি ছিল। নিজের চিকিৎসা, বউয়ের তিনটি অপারেশন ও প্রতিবন্ধী ছোট ছেলের চিকিৎসায় ১১ বিঘা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন চার বিঘার মতো জমি আছে। সেখান থেকে কিছু ধান পাই। কিন্তু শুধু ভাত কি মুখে ওঠে! একটু শাক, একটু ডাল জোগাড় করাই আমার জন্য কঠিন। ছোট মাছ হয়তো সপ্তাহে এক দিন খাই। আর মুরগির মাংস মাসে, দুই মাসে একবার। আমার এই বন্ধু ইব্রাহিম সাহায্য করে খুব। আর ট্রান্সকমের ডেপুটি ডিরেক্টর গোলাম কুদ্দুস বাবু ভাই। ওনার সঙ্গে ভলিবল খেলেছি; এত বড় হয়েও উনি মনে রেখেছেন তা। এই বাবু ভাই প্রতি মাসে বিকাশ করে ছয় হাজার টাকা পাঠান টাঙ্গাইলে। ইব্রাহিমও সাধ্যমতো দেড়-দুই হাজার টাকা করে দেয়। তা দিয়ে পেট চালাই কোনোমতে। আমার স্ত্রীও খুব অসুস্থ। ওর তিনটি অপারেশন হয়েছে। বড় ছেলে আলাদা হয়ে গেছে। রাস্তায় দেখা হলেও আমার সঙ্গে কথা বলে না। বউ চলে গেছে ছোট ছেলের। আমার, স্ত্রীর এবং প্রতিবন্ধী ছোট ছেলেটির রান্না আমিই করি। টিনের একটা ঘরে থাকি। বৃষ্টি হলে সমানে পানি পড়ে। এই দেখুন, আমার ভলিবলের সার্টিফিকেটগুলোও ভিজে গেছে। দাদা, জীবনটা কষ্টে কষ্টেই কাটল। এলাকার লোকজন বলে, ‘আপনি নাকি এত বড় ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন, তাহলে এত কষ্টের জীবন কেন?’ এই প্রশ্নের কোনো জবাব আমার কাছে নেই।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> ছোট ছেলেটি প্রতিবন্ধী বলছিলেন। তা কি জন্ম থেকেই?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ওকে নিয়েই আমার সব দুঃখ। নাম ভোলানাথ পাল; বয়স ৩৫-৩৬ বছর। ইন্টার পাস করেছে। ছোটবেলা থেকেই রাতকানা ছিল। এখন দিনেও চোখে কম দেখে। দুপুরের পর থেকে অন্যের সাহায্য ছাড়া কিছু করতে পারে না। চোখের ওই সমস্যা থেকে শারীরিক আরো নানা সমস্যা হয়েছে। মাথায় গণ্ডগোল হওয়ায় পাবনা পাগলা গারদে পর্যন্ত রাখতে হয়েছে দুই মাস। এখন মাথার সমস্যা নেই। কিন্তু বউ ওকে তালাক দিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটি এখন বলছে, ‘বাবা ও মা, তোমরা দুজন মরে গেলে আমাকে কে দেখবে? তার আগেই আমি রেলের তলে পড়ে আত্মহত্যা করব।’ বাবা হয়ে আমি তা মানতে পারি! ওকে বলি, ‘বাবা, ধৈর্য ধর। আমি খেলোয়াড় ছিলাম বলে এখনই হাল ছাড়ব না। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে দেখি কী হয়।’ সরকার কিংবা সমাজের যাঁরা বড়লোক, তাঁদের কাছে এখন আমার একটাই আবদার—আমার পেসমেকার বসানোর টাকা চাই না; ৭৪ বছরে পৃথিবী অনেক দেখেছি; এখন মরে গেলেও অসুবিধা নেই। শুধু আমার এই ছোট ছেলেটাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেন। অন্ধ কল্যাণ সমিতি আছে, এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ও কাজ করতে পারে। ওর চাকরি হলে আমি খুশি মনে মরে যাব।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> এককালে পুরো দেশ যাকে এক নামে চিনত, সেই তুমুল জনপ্রিয় ভলিবল খেলোয়াড় নিখিল পালের সঙ্গে আপনার এখনকার জীবন একেবারেই বেমানান। তবু আমাদের যদি সেই জীবনের কথা একটু বলেন? যদি জানান, ভলিবলের সঙ্গে পরিচয় কিভাবে?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> আমার জন্ম টাঙ্গাইলে। বাবা স্বর্গীয় রাজেন্দ্রলাল পাল; মা স্বর্গীয় ননী বালা পাল। ছয় ভাই, ছয় বোনের মধ্যে আমি তিন নম্বর। পাড়ায় ছিল কদমতলী জিন্দা মেমোরিয়াল ক্লাব। সেখানে বড় ভাই রাখাল পাল ভলিবল খেলেন। আমি ক্লাবে গিয়ে বসে থাকি, বল এদিক-ওদিক গেলে কুড়িয়ে আনি। কখনো খেলোয়াড় কম থাকলে খেলার সুযোগ পাই। এভাবেই ভলিবলের শুরু। খেলাটি আমার এত পছন্দ হয় যে, ঘুমের মধ্যে খেলতাম। এদিক-ওদিক দেয়ালে ঘুষি মারতাম। মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলতেন, ‘কী রে, তুই এমন করস কেন?’ তবে এই ভলিবল খেলাটি ভালো করে শিখেছি অবশ্য ভারত গিয়ে।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> ভারত গেলেন কবে?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ব্রাহ্মণ শাসন এইউ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি আমি। এরপর চাকরির চেষ্টা করি অনেক, কাজ হয় না। বোঝেনই তো, পাকিস্তান আমলে সরকারের হিন্দুবিদ্বেষী ভাব ছিল। রাগ করে তাই চলে যাই আসামে; আমার এক ভাইয়ের কাছে। ওখানে ভলিবল খেলার চল ছিল; এক কোচের অধীনে বিনা পয়সায় খেলাটি শিখি ভালোভাবে। ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আসামে ছিলাম। পরে গ্রাম পুলিশের একটি চাকরি পাই ঠিকই; কিন্তু মানুষের বাড়ি-ঘর, গরু-বাছুর পাহারা দেওয়ার চাকরি পছন্দ হয়নি। যুদ্ধের পর তাই বাংলাদেশে চলে আসি।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> ভলিবলে জাতীয় পর্যায়ে খেলা শুরু কিভাবে?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> তার আগে একটি কথা বলে রাখি। আমি কিন্তু ভালো ফুটবলও খেলতাম। যুদ্ধের আগে খেলেছি আন্তস্কুল ফুটবল। আমাদের স্কুল এক না দুবার চ্যাম্পিয়নও হয়। খেলেছি টাঙ্গাইল জেলা দলেও। ফুটবলে আমার পজিশন ছিল ব্যাক। কিকের জোর ছিল খুব। লম্বা-চওড়া আমাকে দেখে অনেকে ভয় পেত। আর ভলিবলে জাতীয় পর্যায়ে শুরুর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। ওই যে বড় ভাই রাখাল পালের কথা বললাম, উনি শুরু করেন মাসকালাই ডালের ব্যবসা। টাঙ্গাইল থেকে আমাকে নিয়ে আসেন ঢাকার রহমতগঞ্জে। উনি নিজে ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন, খেলাটি যে আমি একটু-আধটু পারি, তা জানেন। ডালের ব্যবসায় কাজে লাগানোর পাশাপাশি আমাকে নিয়ে যান ওয়াপদায়। ওই দলের হয়ে ঢাকা লিগে ভলিবল শুরু। এক বছর খেলি ওয়ারীতে। পরে চাকরি হয় বিটিএমসিতে। ঢাকা লিগে এরপর সেখানেই খেলি।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> টাকা-পয়সা?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> বিটিএমসিতে শুরুতে পেতাম দৈনিক আট টাকা করে। যেদিন অফিস বন্ধ, সেদিন টাকাও বন্ধ। আর ১৯৯৩ সালে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে যখন আমাদের বিদায় করে দেয়, তখন মনে হয় বেতন পেতাম তিন কি চার হাজার টাকা। সঙ্গে চাকরি ছাড়ার সময় আরো লাখ দুয়েক পেয়েছিলাম। যত দিন খেলোয়াড় হিসেবে ছিলাম, বিটিএমসির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল ঢাকা লিগে। এ ছাড়া জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতাম টাঙ্গাইল জেলার হয়ে। আন্তজেলা ভলিবলে টাঙ্গাইলকে চ্যাম্পিয়নও করিয়েছি।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> ভলিবল খেলা শেখানোর মতো কোচ ছিল বাংলাদেশে?</p> <p><strong>নিখিল পাল</strong> <strong>:</strong> আমি বেশির ভাগ শিখেছি ভারতের আসামে গিয়ে। আর পরে রাশিয়ার ভ্যালেরি প্যাট্রোনকোর কাছ থেকে। ১৯৭৫ সালে ওই কোচ আসনে ঢাকায়। তাঁর কাছ থেকেই আধুনিক ভলিবলের নানা টেকনিক শিখি। সেগুলো অনুশীলন করতে করতেই আরো ভালো খেলোয়াড় হই।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> ভলিবলের ওই জমজমাট সময়ে প্রচুর খেপও নিশ্চয়ই খেলেছেন?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> দেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানেই খেপ খেলতে যাইনি। আর যেখানেই গেছি, আমাকে দেখার জন্য গ্রাম ভেঙে পড়েছে। আমাকে দুই শ, তিন শ টাকা দেওয়া হতো। এখন তো জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা ১০-১৫ হাজার টাকা করে নেয়। এখানে একটি স্মৃতির কথা মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ভাইয়ের নামে একটি ভলিবল টুর্নামেন্ট হয় খুলনায়। সেখানে আমি, কানুদা, সুভাষ এমন বেশ কয়েকজন ঢাকা থেকে খেলতে যাই। বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসেরের খুলনার বাসায় আমরা খেতেও গিয়েছিলাম। শেখ কামালের ইচ্ছে ছিল, একটি ভলিবল দল গঠনের। পরে তো মারাই গেলেন। আর খেপ নিয়ে আমার একটি দুঃখের স্মৃতি হলো, এই খেপ খেলতে গিয়েই আমার পা ভাঙে। কালিয়াকৈরে গিয়েছিলাম। স্ম্যাশ করার পর ল্যান্ডিংয়ের সময় নড়ে যায় বাঁ হাঁটু। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই মাঠে। হাসপাতালে থাকতে হয় কিছু দিন। তখন দেশে হাঁটুর অপারেশনের ভালো ব্যবস্থা ছিল না। আলুবাজার থেকে মাণ্ডার তেল এনে তা মালিশ করে ব্যান্ডেজ করি। এভাবেই একটু একটু ভালো হই।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> এটি কত সালের ঘটনা?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ১৯৭৮ হবে হয়তো। এর পরও আমি খেলেছি। কিন্তু আগের সেই ফর্ম আর ছিল না। হাঁটুতে জোর পেতাম না। ওই সময় আবার দলকে হারতে দেখতে রাগ হতো খুব। মেজাজ ঠিক রাখতে পারতাম না। একটা ম্যাচের কথা বলি। হাঁটুতে ব্যথা পাওয়ার পর আমার খেলা বারণ। ওদিকে মাঠের পাশে বসে দেখছি বিটিএমসি হেরে যাচ্ছে। মহসিন ভাই নামে এক কর্মকর্তা ছিলেন। উনি বললেন, ‘নিখিল, সাহস করে মাঠে নামবা নাকি?’ আমি বলি, ‘নামব না মানে?’ ওই ল্যাংড়া পা নিয়ে নেমে দলকে আমি জিতিয়েছি। এটি আমার জীবনের স্মরণীয় এক খেলা।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> আরো কিছু স্মরণীয় ম্যাচের কথা যদি বলেন?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ১৯৭৬ সালের জাতীয় ফাইনালের কথা মনে আছে। খেলাটি হয় কুষ্টিয়ায়। আমরা টাঙ্গাইলের হয়ে খেলি বিমান বাহিনীর বিপক্ষে। একটা গেম ওদের ‘নিল’-এ দিয়েছি; ১ পয়েন্টও নিতে দিইনি। কুষ্টিয়ায় লালন ফকিরের আখড়ার ওখানে একটি বড় পুকুর আছে। ম্যাচের আগে সাঁতার কেটে ওই পুকুরের এ মাথা-ও মাথা করি কয়েকবার। আর ভক্তি করে মনে মনে বলি, ‘আমার দল যেন এবার চ্যাম্পিয়ন হয়।’ তাই হয়েছে। তবে বিমান বাহিনীর মতো দলকে নিলে গেম দেব, এতটা ভাবিনি। সেটি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলা। আরেক শ্রেষ্ঠ খেলা তাসখন্দ ডায়নামোর বিপক্ষে রাজশাহীতে যে ম্যাচটি খেলেছিলাম। সেদিনও আমার খেলা খুব উঠেছিল। যদিও হারি ম্যাচটিতে।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> ক্যারিয়ারের ওই তুঙ্গে থাকার সময় ঢাকা থেকে যখন বাড়ি ফিরতেন, লোকজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসত না?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> দশ গ্রামের লোক আসত। আমি ছিলাম সবার হিরো। সবার সঙ্গে কথা বলতে আমারও মজা লাগত। মনে আছে, আমি ঢাকা থেকে বাড়ি গিয়ে খেলতাম পোলাপানদের সঙ্গে। ওরা ৯ জন, আমি একা। একা ব্লক করি, একা বল ওঠাই, একাই চাপ দিই। আমার ওই একার সঙ্গে ওরা ৯ জন পারত না। এলাকায় এই খেলা দেখার জন্যও দুই-চার শ লোক জড়ো হয়ে যেত। ৯ জনের সঙ্গে বাজিতে জিতলেও আমিই ওদের খাওয়াতাম। এলাকার ছোট ভাই না ওরা! এ ছাড়া নিজ গ্রামের হয়ে অন্য গ্রামের সঙ্গে অনেক খেলা খেলে দিয়েছি। কখনো টাকা নিইনি। আমার লোভ ছিল ভলিবল খেলার প্রতি, টাকা-পয়সার দিকে কোনো লোভ ছিল না। খেলার বাইরে কিছু উপার্জন করতে হবে, তা কখনো ভাবিনি। তখন যদি তেমনটা ভাবতাম, তাহলে আমার জীবনে এখন এত দুর্দশা আসত না।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> জাতীয় দলে খেলেন কত দিন?</p> <p>নিখিল পাল : তখন তো আর জাতীয় দল সেভাবে হতো না। তাসখন্দের ওই দলের বিপক্ষে খেলি, আরেকটি কোন দল যেন এসেছিল—তাদের বিপক্ষেও ছিলাম আমি। এর বাইরে জাতীয় দলের তেমন কোনো কার্যক্রমই ছিল না।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> শেষ খেলেন কবে?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ওই হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ার পর ফর্ম পড়ে আসে। তবু ফিরে আসে, দু-এক বছর চেষ্টা করি। আগের মতো আর পারি না। শেষ খেলি সম্ভবত ১৯৮০-৮১ সালে। এর পরপর আমি টাঙ্গাইল যুব দলের কোচ হয়ে যাই। জেলা দলের কোচও হই। ইয়াদ আলী কিন্তু আমার টাঙ্গাইল দলেও খেলেছে। ভলিবলের প্রতি আমার ভালোবাসা এখনো আছে। পেপারে যদি দেখি, ঢাকায় কোনো টুর্নামেন্ট হচ্ছে, দৌড়ে ছুটে আসি। চিন্তা করে দেখুন, পেটে ভাত নেই কিন্তু খেলা দেখতে চলে আসি ঢাকা। যদিও এই ভালোবাসার মূল্য আমি পাইনি।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> বিয়ে করেন কবে?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> সম্ভবত ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে। বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি। আমি তো খেলা নিয়েই থাকতাম, বিয়ে করার ভাবনা আগে মাথায় আসেনি। বাবা আমার জন্য মেয়ে দেখতে যান, আমি বলি, মেয়ে পছন্দ না। এভাবে অনেক দিন ঠেকিয়ে রাখি। পরে বিয়ে করি ইতি রানী পালকে। আমাদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে কালাচাঁদ পালের কথা তো বললামই, রাস্তায় দেখা হলেও কথা বলে না। ঝগড়া হলে বলে, ‘তুমি নাকি এত বড় ভলিবল খেলোয়াড়, বঙ্গবন্ধু তোমাকে আদর করেছেন, তুমি নাকি আওয়ামী লীগার—তাহলে জীবনে কী করলা? আমাকে একটা চাকরি পর্যন্ত দিতে পার না কেন?’ কী বলব, বলেন? ছোট ছেলে ভোলানাথ পাল প্রতিবন্ধী। মেয়ে সুমনি রানী পালের বিয়ে দিয়েছি ময়মনসিংহে। ও আমার খোঁজখবর রাখে।</p> <p><strong>প্রশ্ন :</strong> এতক্ষণ কথাবার্তায় যা শুনলাম, তাতে এই শেষ প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা অর্থহীন। তবু জানতে চাই, ক্যারিয়ার নিয়ে, জীবন নিয়ে আপনার তৃপ্তি কতটা? আর আফসোসের জায়গাই বা কতটুকুন?</p> <p><strong>নিখিল পাল :</strong> ভলিবলের নিখিল পাল হিসেবে ভালো লাগে। এখনো যখন পুরনো দিনের কেউ পরিচয় হলে আমার খেলোয়াড়ি জীবনের কথা মনে করিয়ে দেন, গর্ব হয়। আবার ভাবি, অমন খেলোয়াড় হিসেবে রাষ্ট্রের, সরকারের কাছ থেকে আমি কী পেয়েছি! কিছুই না। সরকার থেকে একটা বয়স্ক ভাতা পর্যন্ত পেলাম না। কর্মকর্তারা কত দিন ধরে বলছেন, কেউ মরলে সেখানে আমার নাম ঢুকিয়ে দেবে। দেয় না তো! টাকা চায়। এত দুঃখ-কষ্ট সয়েও এই ৭৪ বছর বয়স পর্যন্ত যে বেঁচে আছি, তা বাবু ভাই ও বন্ধু ইব্রাহিমের জন্য। ওনারা সাহায্য না করলে এত দিনে আমার দেহ আগুনে খেয়ে ফেলত। কিছু দিন আগে দিলু খন্দকার ভাই আমাকে সাহায্য করার জন্য অনেক অনুরোধ করেন সরকারকে। এরপর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে গিয়ে শুনি, আমার নামে চেক হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টাকার। কেন? আমি ভিক্ষুক নাকি? ভলিবল খেলে এই দেশকে, এই দেশের দর্শকদের কিছুই দিইনি? অবশ্য আমার এই রাগ দেখার মতোও এখন কেউ নেই।</p> <p>এখন আমার জীবনে একটাই চিন্তা—প্রতিবন্ধী ছেলেটির যেন একটি গতি করে দিতে পারি। নইলে আমি মরে গেলে ও-ও আত্মহত্যা করবে। আর নিজের কথা কী বলব! তিন মাস পর পেসমেকার বদলাতে হবে। তা যদি সরকার বা অন্য কেউ করে দেন, ভালো। না হলে নাই। ৭৪ বছর বয়সের এই আমি মরে গেলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না।</p>