<p>নতুন পত্রপল্লব আর ফুলে ছাওয়া বাগিচা ও দক্ষিণা হাওয়া তো ছিলই, বুলবুলের অভাবও বুঝতে দেয়নি সুকণ্ঠী কোকিল। প্রেম ও বিদ্রোহের কবির প্রিয় সব অনুষঙ্গই যেন উপস্থিত ছিল রাজধানীর গুলশান সোসাইটি লেক পার্কে। গতকাল শুক্রবার এমনই মনপ্রাণ উতাল করা বসন্তের সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী নজরুল উৎসব। অনিবার্য কিছু গুরুগম্ভীর আলোচনার পর নজরুলের কথা-গান কণ্ঠে তুলে নিলেন বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতের শিল্পীরা।</p> <p>বাংলাদেশ নজরুলসংগীত সংস্থা, গুলশান সোসাইটি ও ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার এই উৎসবের উদ্যোক্তা। উৎসবের প্রথম দিন ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান, কবিতা আবৃত্তি ও রচনার ভিত্তিতে নৃত্য। এদিন দুই বাংলার শিল্পীদের কণ্ঠে বাজে নজরুলের ঐশ্বর্যময় সৃষ্টির নির্যাস। গীত হয় স্বদেশের বন্দনা থেকে প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ আর জাগরণের বার্তাবহ বাণী।</p> <p>উৎসবের উদ্বোধন করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক, সংস্কৃতিসচিব খলিল আহমদ, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা, নজরুল উৎসবের আহ্বায়ক খায়রুল আনাম শাকিল ও গুলশান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ওমর সাদাত। তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশকে।</p> <p>উৎসবের আহ্বায়ক খায়রুল আনাম শাকিল নজরুলের গানের নিবেদিতপ্রাণ, লব্ধপ্রতিষ্ঠ শিল্পী। স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিল্পসৃষ্টি ও মূল্যবোধ আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নজরুলের যেমন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎস থেকে আহরণ করে শিল্প সৃষ্টির ক্ষমতা ছিল, তেমনি তাঁর একটি গভীর মানবিক বাঙালি চেতনাও ছিল, যেখানে হিন্দু-মুসলমান, জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ ছিল না। তিনি বঞ্চিতদের বেদনায় কাতর হয়েছেন, শোষিতের অত্যাচারে ক্ষিপ্ত হয়েছেন।</p> <p>গতকাল ৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি ও চেতনায় নারীর অবস্থান বিষয়ে মফিদুল হক বলেন, “নজরুলের গানে-কবিতায় বহুভাবে আমরা নারীর আরাধনা দেখি। ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ গানে নারী জাগরণের বাইরেও নারীকে তিনি এক অসাধারণ শক্তির উদগাতা হিসেবে কামনা করেছেন।”</p> <p>ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম এক অসামান্য প্রতিভা। এই উৎসব শুধু মহান এ কবিকে স্মরণের জন্য নয়, বরং দুই দেশের অভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার উদযাপনের জন্যও। এটি ভারত ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিনিময়ের দারুণ প্ল্যাটফরম।</p> <p>সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘আবশ্যিক নজরুল’ নামে ৮০০ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বইটি শিগগিরই প্রকাশিত হবে। অন্যদিকে নজরুলের ১২৫তম জন্মদিনে ‘এসেনশিয়াল নজরুল’ নামে বইটির ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সচিব আরো জানান, জাতীয় কবির ১৭ খণ্ডের রচনাসমগ্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।</p> <p> </p> <p>পরিবেশনা পর্ব</p> <p>পরিবেশনা পর্বের শুরুতে পরিবেশিত হয় দেশ পর্যায়ের গান ও পাঠের ধারাভাষ্যময় গীতি আলেখ্য ‘পঞ্চাঙ্গনা’। এর পর নবীন ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা শোনান দেশাত্মবোধ, ভক্তি, মানবতা আর সম্প্রীতির বার্তাবহ অনেক গান। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন ইয়াসমিন মুশতারী, শারমিন সাথী ইসলাম, সৈয়দা সানজিদা জোহরা বীথিকা, সুনীল সূত্রধর, আফসানা রুমা, সুমন মজুমদার, আনুস্কা চক্রবর্তী দিয়া, সালাউদ্দিন আহমেদ, কানিজ হুসনা আহম্মাদী, সুপ্রিয়া দাশ, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী দেবারতি দত্ত, মনোময় ভট্টাচার্য, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে। তাঁদের কণ্ঠে গীত কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে ছিল ‘ছাড়িতে পরান নাহি চায়’, ‘পরান প্রিয় কেন এলে অবেলায়’, ‘স্বদেশ আমার! জানি না তোমার শুধিব মা কবে ঋণ’, ‘ভাইয়ের দোরে ভাই’, ‘গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ওই’, ‘মাগো চিন্ময় রূপ ধরে আয়’, ‘কেন ফোটে কেন কুসুম ঝরে যায়’। বাচিকশিল্পী শিমুল মুস্তাফা শোনান দেশপ্রেমের অনন্য আখ্যান ‘নম নম নম বাংলাদেশ মম’ কবিতাটি। লায়লা আফরোজ আবৃত্তি করেন নজরুলের ‘নারী’ শীর্ষক কবিতা। ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানের সুরে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নাচ পরিবেশন করে নৃত্যনন্দন।</p> <p>আজ শনিবার দ্বিতীয় দিনের উৎসব শুরু হবে বিকেল ৫টায়। মঞ্চে সংগীত পরিবেশনার পাশাপাশি উৎসব উপলক্ষে শুদ্ধ সুর ও বাণীতে গীত নজরুলের ১২৫টি গানের সংকলন ইউটিউবে উন্মুক্ত করার কথা রয়েছে আজ। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত শিল্পীরা।</p> <p> </p> <p> </p>