<p>হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম নিয়ে কিশোরগঞ্জ-৪ আসন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে মো. আবদুল হামিদ সাতটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই আসনটির প্রতি দেশবাসীর রয়েছে বাড়তি আগ্রহ।</p> <p>‘কে কোন দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন’, ‘কোন প্রার্থী নির্বাচিত হলে হাওরের প্রকৃত উন্নয়ন হবে’ অথবা ‘কোন দল ক্ষমতায় গেলে হাওরবাসীর ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব’ ইত্যাদি আলোচনা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠ-ঘাট চষে ফিরছেন।</p> <p>জাতীয় সংসদের ১৬৫ নম্বর নির্বাচনী এলাকা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের বর্তমান সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বড় ছেলে প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তিনি আলোচনায় আছেন। এ ছাড়া দলের জেলা শাখার সভাপতি কামরুল আহসান শাহজাহান মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপিতে সম্ভাব্য প্রার্থীর ছড়াছড়ি। তাঁদের মধ্যে জোর আলোচনায় আছেন সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান।</p> <p>জানা যায়, হাওরের তিন উপজেলাতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে কোন্দল রয়েছে। তবে এ দুই দলের সম্ভাব্য  প্রার্থীরা দলের বিভক্তি, কোন্দল ও নেতাকর্মীদের মান-অভিমান মেটাতে নিরলস কাজ করছেন।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/02 February/26-02-2018/Kalerkantho_18-02-26-34.jpg" style="float:left; height:152px; margin:8px; width:450px" />বিগত ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাতটিতেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জয়লাভ করে সংসদে গেছেন। রাজনৈতিক সাফল্যের ধারাবাহিকতায় হয়েছেন ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার ও রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হলে তাঁর নিজের আসনটি শূন্য হয়। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে তাঁরই বড় ছেলে প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক সংসদ সদস্য হন। পরেরবার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী সৈয়দ অসীমকে পরাজিত করে তিনি আবার সংসদ সদস্য হন।</p> <p><strong>আওয়ামী লীগ :</strong> ‘সরল মানুষ’—এমন ভাবমূর্তির রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক তিন উপজেলায় নিয়মিত যাতায়াত করছেন। সবচেয়ে বেশি ভোটের উপজেলা ইটনায় অবস্থান করছেন বেশি সময়। এর কারণ সম্পর্কে এলাকাবাসীর ভাষ্য, তাঁর বাবার ‘চির প্রতিদ্বন্দ্বী’ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য, একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা মো. ফজলুর রহমানের বাড়ি ইটনায়। এ ছাড়া মিঠামইন উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাহিদুল আলম জাহাঙ্গীর তাঁর ফুফু আছিয়া আলমের ভাসুরের ছেলে।</p> <p>আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা মনে করে, হাওরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কোনো বিকল্প নেই। কারণ স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগে বিকল্প নেতৃত্ব বিকশিত হয়নি। তাদের অভিমত, ইটনার দুই রাজনীতিবিদ মো. ফজলুর রহমান ও মো. শাহাবউদ্দিন ঠাকুর, মিঠামইনের দুই রাজনীতিবিদ মো. জিল্লুর রহমান ও কামরুল আহসান শাহজাহান বা এমন ‘ওজনের’ কাউকে আবদুল হামিদের স্থলাভিষিক্ত করা হলে হাওর তথা দেশই উপকৃত হতো। সেই সুযোগ আপাতত হাতছাড়া হয়ে গেছে।</p> <p>জানা যায়, ফজলুর রহমান কিশোরগঞ্জ-৪ (সাবেক কিশোরগঞ্জ-৫) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে চেয়ে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে দল ত্যাগ করেছেন। মো. শাহাবউদ্দিন ঠাকুর প্রয়াত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতির ভাগ্নে সম্পর্কিত মো. জিল্লুর রহমানকে দুই দফা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। মিঠামইনের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম শাহজাহান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। আগামী নির্বাচনে এ আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে তিনি আরেকজন। তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দীর্ঘ চার দশকের রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। নিষ্ঠার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সবকটি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। রাষ্ট্রপতি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালীন কামরুল টানা প্রায় দুই দশক সহসভাপতি ছিলেন।</p> <p>মনোনয়ন বিষয়ে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের ব্যক্তিগত দুটি মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় একজন সাংবাদিক বলেছেন যে সম্প্রতি সংসদ সদস্য তৌফিকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। সংসদ সদস্য তাঁকে বলেছেন, হাওরের ব্যাপক উন্নয়নে তাঁর বাবা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের গৃহীত কার্যক্রমকে তিনি অব্যাহত রেখেছেন। হাওরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করছেন। তাঁর বাবার রাজনৈতিক শিক্ষা কখনোই ব্যর্থ হবে না। তাঁর বিশ্বাস, হাওরবাসী নিশ্চয়ই তাঁকে মূল্যায়ন করবে। মনোনয়ন প্রসঙ্গে সংসদ সদস্যের ভাষ্য, ‘বড় দলে কিছু সমস্যা থাকবেই। তবে কেন্দ্রের চূড়ান্ত ঘোষণার পর সবাই ঐক্যবদ্ধভাবেই নৌকার পক্ষে কাজ করবে।’</p> <p>আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী কামরুল আহসান শাহজাহান বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার গোপন জরিপে সব মাপকাঠিতেই তিনি যোগ্য। তিনি জনসংযোগ করছেন। দীর্ঘ প্রায় চার দশক তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কাটালেও বিশেষ কোনো রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেননি। তবে সর্বশেষ জেলা কমিটির কাউন্সিলে সভাপতি হিসেবে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁর নাম ঘোষণা করেন।</p> <p>হাওরে উন্নয়ন হয়েছে—এ দাবি করে কামরুল বলেন, ‘এটা রাষ্ট্রপতির অবদান।’ তাঁর মতে, “এমপি হওয়ার পর রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক রাজনীতিতে এসে নিজস্ব ‘বলয়’ তৈরি করেছেন। হাওরে গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ ছিল। কিন্তু নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ না পাওয়ায় ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হয়েছেন।”</p> <p>হাওরে সীমাহীন দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, “কথায় আছে, ‘লাখ টাকার বাগান খাইল দেড় টাকার ছাগলে’—হাওরের এখন এই অবস্থা।”</p> <p><strong>বিএনপি :</strong> কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা কম নয়। এ তালিকায় আছেন সাবেক সংসদ সদস্য মো. ফজলুর রহমান, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান ভূঞা, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ট্রাস্টি ও সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সুরঞ্জন ঘোষ, ইটনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, বিএনপির সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম রতন, সাবেক সংসদ সদস্য ফরহাদ আহাম্মদ কাঞ্চনের ছেলে ড্যাব নেতা ডা. ফেরদৌস আহমেদ চৌধুরী লাকী, মিঠামইন উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাহিদুল আলম জাহাঙ্গীর ও অষ্টগ্রামের ব্যবসায়ী সৈয়দ অসীম। তাঁরা সবাই এলাকার দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।</p> <p>জানা গেছে, ফজলুর রহমান ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে কিশোরগঞ্জ-২ (তৎকালীন সদর উপজেলা) আসন থেকে সংসদ সদস্য হন। বাগ্মিতার জন্য দেশজুড়ে আলোচিত ফজলুর রহমান তখন আওয়ামী লীগেরও সামনের সারির নেতা। আওয়ামী লীগে ‘টিকতে না পেরে’ পরে তিনি কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। হন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক। এ দল থেকে নির্বাচন করে তিনি তৎকালীন সংসদ সদস্য আবদুল হামিদের সঙ্গে ‘কুলিয়ে’ উঠতে পারেননি। দল পরিবর্তন করে তিনি বিএনপিতে চলে যান। হন জেলা বিএনপির সভাপতি। সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মনোনীত হন। তাই এবারও এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাঁরই।  </p> <p>ফজলুর রহমান বলেন, তিনি মাঠে সক্রিয় আছেন। অকাল বন্যায় ফসলহানির পর কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে তিন উপজেলায় গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে গেলে তিনি মনোনয়ন চাইবেন। পেলে শেষবারের মতো নির্বাচন করবেন।</p> <p>ফজলুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে তিনি কার্যত অবরোধের মুখে আছেন। ইচ্ছামতো তিনি জনসংযোগ করতে পারছেন না। ঈদে-পার্বণে বাড়িতে গেলে তাঁকে পুলিশবেষ্টিত করে রাখা হচ্ছে। তাঁর দাবি, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে একদার ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ হাওরে এখন ‘দুর্ভিক্ষাবস্থা’। নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় হাওর তলিয়ে কৃষকের স্বপ্ন শেষ। হাওরবাসীর ঘরে খাবার নেই। জলমহালগুলোতে সাধারণ জেলে ও কৃষকের প্রবেশাধিকার বন্ধ। তাই হাওরের কৃষক এখন পেটের দায়ে রিকশা-ভ্যান চালায়, কুলিগিরি করে, গার্মেন্টে কাজ করে। কৃষককে রক্ষায় বড় কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ না করে উন্নয়নের নামে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের মহোৎসব চলছে। এসবের পরিবর্তনের জন্য তিনি একবার সংসদে হাওরের প্রতিনিধিত্ব করতে চান। </p> <p>বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী ডা. ফেরদৌস আহমেদ চৌধুরী লাকী বলেন, তাঁর বাবা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ফরহাদ আহাম্মদ কাঞ্চন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর রক্তে বিএনপির রাজনীতি। তাঁর চাচা হাবিবুর রহমান ভূঞাও সারা জীবন বিএনপির রাজনীতি করেছেন। তিনিও আজীবন এ দলের রাজনীতি করতে চান। বিএনপির এ দুঃসময়ে তিনি মাঠে রয়েছেন। এবার তিনি মনোনয়ন চাইবেন। পেলে নির্বাচন করবেন, না পেলে মূলধারার সঙ্গে থাকবেন।</p> <p>সংসদ সদস্য হতে পারলে কৃষক-জেলের চিন্তাই আগে করবেন—এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ডা. লাকী বলেন, ‘আমি এমপি হলে জলমহালগুলো নিয়ন্ত্রণে না রেখে একেবারে উন্মুক্ত করে দেব।’</p> <p><strong>অন্যান্য :</strong> এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির অষ্টগ্রাম উপজেলা শাখার সভাপতি কাজী মো. আফতাব ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেতা তপু ভূঁইয়ার নামও শোনা যাচ্ছে।</p>