<p>সাহাবায়ে কেরাম, প্রসিদ্ধ চার মাজহাবের ইমাম ও সব আলেমের ঐকমত্যে কোনো প্রাণীর ছবি প্রস্তুত করা হারাম। ভাস্কর্য, হস্তশিল্প, অঙ্কন, ক্যামেরা বা আধুনিক যেকোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে কারো ছবি বানানো হারাম। হারাম বা নিষিদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে এগুলোর বিধান অভিন্ন। (ইমদাদুল মুফতিয়িন : ৮২৫-৮২৬)</p> <p>আধুনিক যুগে কোনো কোনো দেশের কোনো কোনো আলেম মনে করেন, ছবি ও ভাস্কর্য নিষিদ্ধ করার কারণ হলো, মূর্তিপূজা ও ব্যক্তিপূজার পথ রুদ্ধ করা। তাই তাঁদের মতে, যেসব ছবি পূজা করা হয় না, অতিমাত্রায় শ্রদ্ধা করা হয় না, সেগুলো বৈধ। এ ব্যাপারে রক্ষণশীল ও গ্রহণযোগ্য আলেমদের বক্তব্য ফুটে উঠেছে ইমাম নববীর লেখনীতে। তিনি বলেন, আমাদের শাফেয়ি মাজহাব ও অন্য মাজহাবের আলেমরা বলে থাকেন, কোনো প্রাণীর ছবি প্রস্তুত করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি কবিরা গুনাহ। কেননা এ ব্যাপারে হাদিসে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই ছবি দিয়ে কাউকে সম্মান করা হোক বা অপমান, উভয় অবস্থায় তা হারাম। কেননা এর ফলে আল্লাহর সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য অবলম্বন হয়ে যায়। কাপড়, বিছানা, মুদ্রা, বাসনকোসন, দরজা বা অন্য যেকোনো কিছুতে ছবি আঁকা হারাম। প্রাণীর ছবি ছাড়া অন্যান্য ছবি হারাম নয়। যেমন—গাছপালা, উটের গদি (অশ্ব-জিন) ইত্যাদির ছবি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ নয়। (শরহে নববী : ১৪/৮১)</p> <p>ইসলামী শরিয়ত মতে, কোনো প্রাণীর ছবিযুক্ত পোশাক পরিধান করা হারাম। তবে প্রাণহীন বস্তু যেমন—বৃক্ষ, পাহাড়, ঝরনা ইত্যাদির ছবি বৈধ। (আল-বাহরুর রায়েক : ২/২৯, মেরকাতুল মাফাতিহ : ৪৪৮৯)</p> <p>অনেকে মনে করে, ছবিযুক্ত পোশাক পরিধান করা শুধু নামাজের ক্ষেত্রে হারাম! ফলে তারা নামাজের সময় এ ব্যাপারে খেয়াল রাখলেও অন্য সময় উদাসীন থাকে। অথচ এটা তাদের ভ্রান্ত ধারণা। সর্বাবস্থায় ছবিযুক্ত পোশাক পরিধান করা হারাম। তবে হ্যাঁ, নামাজে এমন পোশাক পরিধান করা গর্হিত অপরাধ।</p> <p>‘খোলাসা’ নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, কোনো ছবিযুক্ত কাপড় দিয়ে নামাজ আদায় করা হোক বা না হোক, উভয় অবস্থায় তা মাকরুহে তাহরিমি বা হারাম। (আল-বাহরুর রায়েক : ২/২৯)</p> <p>ইসলামের দৃষ্টিতে ছবি</p> <p>কোনো প্রাণীর ছবি তোলা, ঘরে সংরক্ষণ করে রাখা বা দেয়ালে ফ্রেমবন্দি করে রাখা ইসলামে নিষিদ্ধ। ছবিতে ধারণকৃত প্রিয়জনের প্রিয় মুখের দিকে মানুষ ফিরে ফিরে তাকায়। পীর-ফকির ও অতি শ্রদ্ধাভাজন কারো ছবি আবেগপ্রবণ মানুষকে মস্তক অবনত করতে বাধ্য করে। কখনো এই ছবি শোকের স্মারক হয়ে ব্যক্তির জীবনকে দুঃখিত, ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত করে তোলে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেলফির প্রতি আসক্তি চোখে পড়ার মতো। সেলফি তোলা এখন চলতি ফ্যাশন, যেভাবে পছন্দের তারকাদের ছবিসংবলিত গেঞ্জি-জার্সি গায়ে দেওয়া ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ঘরে (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না, যে ঘরে কোনো ছবি, কুকুর বা এমন ব্যক্তি থাকে, যার ওপর গোসল করা ফরজ।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪১৫২)</p> <p>মহানবী (সা.) ছবির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পাশাপাশি বাস্তব জীবনেও তিনি এর কঠোর বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের সময় মহানবী (সা.) ‘বাত্বহা’ নামক স্থানে অবস্থান করে ওমর (রা.)-কে কাবা শরিফের ভেতরের সব ছবি ধ্বংস করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সব ছবি নিঃশেষ করার পর মহানবী (সা.) কাবায় প্রবেশ করেন। (আবু দাউদ শরিফ, হা. ৪১৫৬)</p> <p>আজকাল ঘরে ঘরে ছবি টাঙানোর প্রথা শুরু হয়েছে। কি মুসলিম কি অমুসলিম, কি ধনী কি দরিদ্র—সবার ঘরে ঘরে ছবি। পার্থক্য শুধু ফ্রেমে! কারোটা কাঠের বাঁধাই, কারোটা ফুল করা ফার্নিচারে কিংবা পাথরে মোড়ানো। অথচ আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ সম্পূর্ণ এর ব্যতিক্রম। হাদিস শরিফে এসেছে, আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) এক সফর থেকে ফিরে আসেন। (এসে তিনি দেখতে পান) আমি ছবিযুক্ত একটি (দেয়ালের) পর্দা টাঙিয়েছি। তিনি আমাকে তা সরিয়ে নিতে বলেন। অতঃপর আমি তা সরিয়ে ফেলি। (বুখারি শরিফ : হা. ৫৯৫৫)</p> <p>পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ছবি সম্পর্কে যে কথাগুলো পাওয়া যায়, তার সারকথা হলো, ইসলামে কিছু ছবি বৈধ। কিছু ছবি অবৈধ। যেসব পদ্ধতিতে ছবি অবৈধ, তা কয়েক ধরনের—এক. ভাস্কর্য। মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হারাম। স্পষ্টভাবে হাদিস শরিফে এসেছে, (রহমতের) ফেরেশতারা ওই ঘরে প্রবেশ করে না, যেখানে কুকুর, ছবি, ভাস্কর্য ও এমন ব্যক্তি থাকে, যার ওপর গোসল ফরজ হয়েছে। (বুখারি)</p> <p>দুই. আর্ট বা হাতে অঙ্কিত কোনো প্রাণীর ছবিও সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। হাদিস শরিফে এসেছে :</p> <p>অর্থ : যে ব্যক্তি (নিজ হাতে) ছবি নির্মাণ করে, কিয়ামতের দিন সে ছবিতে তাকে প্রাণসঞ্চার করতে বলা হবে। সে প্রাণ দান করতে পারবে না।</p> <p>তিন. এমন সব ছবি ও মূর্তি হারাম, যেগুলোর পূর্ণ আকৃতি ও অবয়ব গঠন করা হয়েছে, প্রাণ ছাড়া প্রাণীর সব কিছুই যার মধ্যে রয়েছে। চাই তা যেকোনো পদার্থ দিয়েই তৈরি হোক না কেন। হাদিস শরিফে এসেছে—</p> <p>অর্থ : কিয়ামতের দিন এমন লোকদের সবচেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টিতে সাদৃশ্য অবলম্বন করে। (বুখারি শরিফ, হা. ৫৯৫৪)</p> <p>চার. কারো প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে যে ছবি ঝুলিয়ে রাখা হয়, আভিজাত্যের প্রতীক ভেবে যে প্রাণীর মূর্তি ও আকৃতি শোপিস হিসেবে সাজিয়ে রাখা হয় এগুলো হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন—</p> <p>হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি (দরজার) পর্দা ছিল। তাতে একটি পাখির ছায়াযুক্ত ছবি ছিল। কেউ এলে তা সামনে পড়ত। অতঃপর মহানবী (সা.) বললেন, আমার সামনে থেকে এটি সরিয়ে নাও। কেননা যখনই আমি এটা দেখি, দুনিয়ার কথা স্মরণ হয়। (মুসলিম শরিফ)</p> <p>যেসব ছবি বৈধ</p> <p>স্মরণ রাখতে হবে, ইসলামে যেকোনো ছবি হারাম নয়। যেসব ছবি বৈধ, সেগুলো কয়েক প্রকার।</p> <p>এক. প্রাণহীন যেকোনো বস্তুর ছবিযুক্ত ভাস্কর্য বৈধ। যেমন—পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, গাছপালা ইত্যাদি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নান্দনিক ছবি তোলা, সংরক্ষণ করা ও দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা বৈধ। শর্ত হলো, সেখানেও প্রাণীর ছবি থাকতে পারবে না। মহানবী (সা.) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বলেছেন—</p> <p>অর্থ : যদি তোমাকে ছবি তুলতেই হয়, তাহলে বৃক্ষ ও এমন বস্তুর ছবি তৈরি করো, যার মধ্যে প্রাণ নেই। (বুখারি ও মুসলিম)</p> <p>দুই. যেসব ছবিতে কোনো প্রাণীর সব অঙ্গের মিলিত ও যৌথ রূপ প্রকাশিত হয় না, সেসব ছবি বৈধ। যেমন—বিচ্ছিন্নভাবে হাত, পা বা চোখের ছবি বৈধ। এর প্রমাণ হলো, আয়েশা (রা.)-এর হাদিস। তিনি বলেছেন—</p> <p>দরজার পর্দায় লাগানো ছবিটি অতঃপর আমি টুকরা করে তা দিয়ে বালিশের কাভার বানিয়েছি। মহানবী (সা.) এ বিষয়ে আমার ওপর আপত্তি করেননি। (সিহাহসিত্তাহ)</p> <p>তিন. পাক-ভারত উপমহাদেশের সব আলেম ও আরব বিশ্বের রক্ষণশীল উলামায়ে কেরামের মতে, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তোলা সেলফি-ছবি নিষিদ্ধ ছবির অন্তর্ভুক্ত। তবে ধর্মীয় প্রয়োজনে যেমন—হজে যাওয়ার জন্য বা জাগতিক অপরিহার্য বিষয়ের ক্ষেত্রে এমন ডিজিটাল ছবি তোলার অনুমতি আছে। শরিয়তের ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘জরুরত’। এর মানে হলো, এই ছবি না হলে ব্যক্তির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। যেমন—রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্র, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি ইত্যাদির প্রয়োজনে ছবি তোলা বৈধ।</p> <p>লেখক : শিক্ষক, মাদরাসাতুল মদিনা</p> <p>নবাবপুর, ঢাকা।</p>