<p>স্বাধীনতার পর ইসলামের প্রচার ও প্রসারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’, ‘মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন’, ‘বিশ্ব ইজতিমা’র জন্য জমি বরাদ্দ করাসহ অসংখ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘অ্যারাবিক অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ’ থেকে ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ আলাদা হলো। কিন্তু বর্তমানে কলেজ পর্যায়ে বিষয়টির অবস্থা ভালো নেই। বিশেষত, উচ্চ মাধ্যমিকে বিষয়টিকে ঐচ্ছিক করা এবং ডিগ্রি স্তরে নানা নিয়মের শৃঙ্খলে বিষয়টি পাঠ্য হিসেবে গ্রহণের সুযোগ সীমিত হওয়ার ফলে ইসলাম শিক্ষার ছাত্র-ছাত্রী হ্রাস পেয়ে বিষয়টি প্রায় বিলুপ্তির পথ ধরেছে। অন্যদিকে অসতর্কতাবশত কলেজে ইসলাম শিক্ষা সিলেবাসে হজরত মুহাম্মদ (সা.) উপেক্ষিত হচ্ছেন!</p> <p>আশির দশকের শুরুতে যখন কলেজে পড়ি, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন কলেজে পড়াতে শুরু করি, তখন থেকে দেখে আসছি, উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ইসলাম শিক্ষায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) সংক্রান্ত অধ্যায় ছিল। ওই অধ্যায় থেকে ফাইনাল পরীক্ষায় একটি রচনামূলক প্রশ্ন থাকত, যার জন্য ২০ নম্বর বরাদ্দ ছিল। সহজ ও জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় হওয়ায় একমাত্র হজরত মুহাম্মদ (সা.) সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উত্তর লেখার কল্যাণে পরীক্ষার্থী তার পাসের প্রত্যাশাকে বহুদূর এগিয়ে নিত। অথচ নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে যখন ইসলাম শিক্ষার সিলেবাস বদলে গেল, তখন অনেক নতুন, আধুনিক ও সময়োপযোগী প্রসঙ্গ যুক্ত হলো। শুধু উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ইসলাম শিক্ষা সিলেবাস থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সংক্রান্ত অধ্যায়টি হারিয়ে গেল! এ দোষ কি শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের, না ওই সময়ে সিলেবাস প্রণয়ন কমিটির বিষয়বিশেষজ্ঞদের? ওই সময় সিলেবাস প্রণয়নে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কী বুঝে এমনটি করলেন? এভাবেই দীর্ঘ ২০ বছর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ইসলাম শিক্ষার সিলেবাসে উপেক্ষিত হজরত মুহাম্মদ (সা.)।</p> <p>যদিও বর্তমানে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইসলাম শিক্ষা শুধু মানবিক শাখায় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু কলেজ পর্যায়ে ‘ইসলাম শিক্ষা’ স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশকালে সব গ্রুপের সবাই বিষয়টি নিত, ফলে ১৯৯৮ বা আরো পূর্বকাল থেকে বিষয়টি আবশ্যিকের গুরুত্ব রাখত। ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি তখন সব শিক্ষার্থীর পছন্দের শীর্ষে ছিল। এমনকি জানার আগ্রহ ও সহজে বেশি নম্বরের প্রত্যাশায় ইসলাম শিক্ষা শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সীমাবদ্ধ ছিল না।</p> <p>আশির দশকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ইসলাম শিক্ষার জন্য ড. আলাউদ্দিন আল-আজহারি (রহ.) প্রণীত বইটি ছিল প্রথম ও একমাত্র। পরবর্তী সময় আসে আ. মান্নান-কোরবান আলীর বই, আরো পরে আসে আ.ন.ম রইছ উদ্দিন স্যারের বই। ওই সব বইয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সংক্রান্ত অধ্যায়টি ছিল শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। নবীপ্রেম ও সিরাত চর্চায় ওই অধ্যায়টি এক অতুলনীয় সুযোগ।</p> <p>ড. আলাউদ্দিন আল-আজহারি (রহ.) প্রণীত বইটিতে ছিল, আদর্শ মহামানব সম্পর্কে বিবরণ। পরীক্ষায় ২০ নম্বরের যেসব প্রশ্ন আসত, তাতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে শিক্ষার্থী ব্যাপক ধারণা পেত। ওই সময়ে সিলেবাসে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব, শৈশব, নবুয়তপ্রাপ্তি, মাক্কি ও মাদানি জীবন, আদর্শ জীবনচরিত, তাঁর ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংস্কার, বিদায় হজের ভাষণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।</p> <p>ডিগ্রি পর্যায়েও হজরত মুহাম্মদ (সা.) অধ্যয়নের সুযোগ নেই। যদিও দ্বিতীয় পত্রের আল কালাম শাস্ত্রে রিসালাত, খতমে নবুয়ত (সর্বশেষ নবী) প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু এতে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত জানার সুযোগ নেই। বরং এতে শুধু বিশ্বাসগত তাত্ত্বিক আলোচনার অবকাশ আছে। ফলে শিক্ষার্থী ডিগ্রিতে ইসলামিক স্টাডিজ পড়েছে, অথচ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম-মৃত্যু, নবুয়ত, হিজরতসহ অনেক মৌলিক বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলবে—‘আমাদের সিলেবাসে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পড়ার সুযোগ ছিল না।’ এটা কি লজ্জা, নাকি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য!</p> <p>অনেকে বলবেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.) পড়ার সুযোগ তো ইসলামের ইতিহাসেই আছে। ইসলামিক স্টাডিজে আবার হজরত মুহাম্মদ (সা.) পড়ার কী প্রয়োজন? জবাব সহজ, ইসলাম জানা-শেখার বিদ্যা হলো; ইসলামিক স্টাডিজ। অথচ এ বিদ্যায়ই উপেক্ষিত হজরত মুহাম্মদ (সা.)!</p> <p>কলেজে কলেজে ‘কম্পিউটার শিক্ষা’ ছিল, মানুষের ঘরে ঘরে, অফিসে-দোকানে কম্পিউটার আছে, তার পরও স্কুল থেকে শুরু করে কলেজের স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত আইসিটি বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেন শিক্ষার্থীর কম্পিউটার বিষয়ক জ্ঞান শাণিত হয় এবং প্রায়োগিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। একই যুক্তিতে, শিক্ষার্থীর ঈমানি শক্তির বিকাশ ও নবীপ্রেম জাগ্রত করতে কলেজের স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত হজরত মুহাম্মদ (সা.) অধ্যয়নের সুযোগ রাখা জরুরি।</p> <p>কলেজে কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস আছে। তারপর আমাদের মহান স্বাধীনতার চেতনা বিকাশের জন্য ডিগ্রি পাস ও অনার্স কোর্সে ১০০ নম্বরের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ বিষয়টি সব শাখা, বিভাগের জন্য আবশ্যিক। একই যুক্তিতে, যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই নবীপ্রেমিক, সেহেতু কলেজে হজরত মুহাম্মদ (সা.) অধ্যয়নের প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।</p> <p>ডিগ্রি পাস কোর্সে ইসলামিক স্টাডিজের মোট ৬০০ নম্বরের মধ্যে সিলেবাসে অন্তত ৫০ নম্বর হজরত মুহাম্মদ (সা.) অধ্যয়নের সুযোগ রাখার আকাঙ্ক্ষা খুবই অমূলক? বরং ডিগ্রি পাস কোর্সে ইসলামিক স্টাডিজের পঞ্চম পত্রে (ইসলামী সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা) হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিরোনামে একটি অধ্যায় সংযুক্তি একান্তই যুক্তিযুক্ত।</p> <p>অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিরোনামে একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা কোনো আবদার বা নতুন প্রস্তাব নয়। বরং আগেই তো এসংক্রান্ত ২০ নম্বর ছিল, শুধু নতুন করে তা চালু করা দরকার।</p> <p>আমাদের ঈমানি দাবি, প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি ভক্তিময় আবেগ ‘সিরাতচর্চা’। বিশ্বের একমাত্র অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যাঁর নাম গর্ব, শ্রদ্ধায় নামের সূচনায় মানুষ লেখে এবং নিজের পরিচয় দেয় ‘মুহাম্মদ’ তথা ‘উম্মতে মুহাম্মদি’ হিসেবে। তাই কাজী নজরুল ইসলামের ভক্তিময় উচ্চারণ—</p> <p>‘মুহাম্মদ নাম যতই যপি ততই মধুর লাগে</p> <p>নামে এত মধু থাকে কে জানিত আগে।’</p> <p>জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের গুরুত্ব বিবেচনায় বলা হয় No college no knowledge। যদি শিক্ষার্থী তার জীবনের বিকশিত পর্যায়ে প্রিয় নবী (সা.)-এর জীবনচরিত সম্পর্কে অধ্যয়নের সুযোগ পায়, তাহলে এর প্রভাব থাকবে তার সারা জীবন।</p> <p>কাজেই ঐচ্ছিক না রেখে, কলেজে সব মুসলমান শিক্ষার্থীর জন্য ইসলাম শিক্ষা পাঠের পথ সুগম করা জরুরি। পাশাপাশি হজরত মুহাম্মদ (সা.) অধ্যয়নের সুযোগটুকুও তৈরি করা হোক কলেজের ইসলাম শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে।</p> <p>লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ কাপাসিয়া, গাজীপুর।</p>