<p>মৃত্যু আসার আগেই বান্দার উচিত তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। নিঃসন্দেহে মৃত্যু আমাদের সবার কাছেই আসবে। ছোট-বড় সবার ওপর মৃত্যু ঝাঁপিয়ে পড়বে। মৃত্যু কোনো বান্দাকে সময় দেয় না। গোছগাছ করার জন্য কোনো ধরনের সুযোগও দেয় না। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা সংশোধনের পথ হচ্ছে তাওবা ও নেক আমল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তোমাদের যে জীবিকা দিয়েছি, তা থেকে দান করো তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগেই। তখন সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে অল্প সময়ের জন্য অবকাশ দিলে না কেন, তাহলে আমি সাদকা করতাম এবং আমি নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। যখন কারো নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেন না। তোমরা কী আমল করো আল্লাহ তার খবর রাখেন।’ (সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ১০, ১১)</p> <p>নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচটি অবস্থার আগে অন্য পাঁচটি অবস্থার মূল্যায়ন করো—বার্ধক্যের আগে যৌবনের, অসুস্থতার আগে সুস্থতার, দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতার, ব্যস্ততার আগে অবসরের এবং মৃত্যুর আগে জীবনের।’ (মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস : ৭৮৪৬)</p> <p><strong>মৃত্যুর পর উপকারী কিছু আমল</strong></p> <p>সন্তানকে নেককার রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা, যাতে তারা পরিবারের জন্য দোয়া করে। শরিয়তের উপকারী ইলম অর্জন ও তা প্রচারের সাধনা। আর সাদকায়ে জারিয়া। এই তিনটি ফজিলতপূর্ণ কাজ নবী করিম (সা.) একটি হাদিসে একসঙ্গে বর্ণনা করেছেন : ‘যখন মানুষ মারা যায় তখন তিনটি ছাড়া তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। সেই তিনটি হলো সাদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেককার সন্তান, যে পিতার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৩১০)</p> <p>কিছু সাদকায়ে জারিয়া আছে, যেগুলো মৃত্যুর পরও মুসলমানের সঙ্গে যোগ হতে থাকে। যেমন—হাদিসে এসেছে : মুমিনের যেসব নেক আমল মৃত্যুর পরও তার আমলনামায় যোগ হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইলম, যা কেউ শিক্ষা করে এবং প্রচার করে। নেককার সন্তান, যাকে দুনিয়ায় রেখে যায়। কোরআন শরিফ, যা উত্তরাধিকার সম্পদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে যায়। মসজিদ, যা নির্মাণ করে যায়। মুসাফিরখানা, যা তৈরি করে যায়। খাল, যা খনন করে যায়। সাদকায়ে জারিয়া, যা জীবন থাকতে সুস্থ অবস্থায় নিজের সম্পদ থেকে আলাদা করে রেখে যায়। মানুষের মৃত্যুর পরও এগুলো তার আমলনামায় যোগ হতে থাকে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪২)</p> <p><strong>অসিয়তনামা লিখে রাখা</strong></p> <p>মৃত্যুর প্রস্তুতির একটি কাজ হলো অসিয়ত লিখে রাখা। সম্পদের কিছু অংশ সাদকা করার ব্যাপারে অসিয়ত করা সুন্নত। কোনো কোনো সাহাবি যাবতীয় সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ অসিয়ত করে গেছেন। কেউ করে গেছেন এক-চতুর্থাংশ। যেমন—নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ তোমাদের ওপর সাদকা করেছেন তোমাদের আমল বৃদ্ধি করার জন্য।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৭০৯)</p> <p>মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে মুসলমানের কোনো বিষয়ে অসিয়ত করার ইচ্ছা আছে, অসিয়ত না লিখে তার দুই রাত অতিবাহিত করার অধিকার নেই।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৭৩৮)</p> <p>আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘যখন এ কথা আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে শুনেছি তখন থেকে এমন কোনো রাত অতিবাহিত হয়নি, যখন আমার অসিয়ত আমার কাছে লিখিত ছিল না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪২৯৪)</p> <p><strong>রুহের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক</strong></p> <p>দেহে অবস্থানকারী রুহের হকিকত নিয়ে মানবসমাজে অনেক মতবিরোধ আছে। এটি অতি সূক্ষ্ম একটি প্রাণী, যা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে রক্ত, গোলাপ ফুলের মধ্যে পানি এবং জলপাইয়ের মধ্যে তেল বিচরণ করার মতো বিচরণ করে। রুহের মাধ্যমেই দেহ জীবিত থাকে। রুহ ও শ্বাস একই বস্তু। এর অবস্থান ক্ষেত্র হচ্ছে দেহ। যখন দেহ থেকে রুহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন দেহ থেকে প্রাণও চলে যায়। রুহ সৃষ্ট বস্তু। তবে দেহের মৃত্যুর কারণে রুহ মৃত্যুবরণ করে না; রুহের দেহ ত্যাগ এবং দেহ থেকে রুহের বের হয়ে যাওয়াই মৃত্যু। তবে রুহ নিঃশেষ হয় না, বরং দেহ ধ্বংস হওয়ার পরও তা অবশিষ্ট থেকে যায়। এই রুহ হয়তো জান্নাতে অথবা জাহান্নামে স্থান পায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে, আল্লাহ তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ অপছন্দ করে, আল্লাহ তার সাক্ষাৎ অপছন্দ করেন।</p> <p><strong>মৃতের সঙ্গে যায় তিন জিনিস</strong></p> <p>দুনিয়ার জীবনে মানুষ অনেক কিছু নিয়ে তৎপর থাকে। সম্পদ জমা করা, আসবাবপত্র খরিদ করা, মূল্যবান গাড়ির ব্যবস্থা করা, বিলাসবহুল বাড়ির মালিক হওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া তার তৎপরতা থাকে স্ত্রী, পরিবার ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে। আমলের দিকেও অনেকের গুরুত্ব থাকে—চাই তার আমল ভালো হোক অথবা মন্দ।</p> <p>যখন মানুষ মারা যায় তখন তিন বস্তু তাকে অনুসরণ করে। গাড়ি বা অন্য কোনো সম্পদ, পরিবারের লোকজন থেকে ভাইবেরাদার ও ছেলেরা, আর তার নেক অথবা বদ আমল। এরপর যখন তাকে দাফন করা হয় তখন দুটি বস্তু ফিরে আসে এবং তার সঙ্গে কবরে থাকে শুধু একটি।</p> <p>হ্যাঁ, পরিবার, সাথি-সঙ্গী, আত্মীয়স্বজন ও সম্পদ ফিরে আসে। থাকে শুধু আমল। আমল তার সঙ্গে কবরে প্রবেশ করে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মৃত ব্যক্তিকে অনুসরণ করে তিন বস্তু। তারপর দুটি ফিরে আসে, একটি তার সঙ্গে থাকে। তাকে অনুসরণ করে পরিবারের লোকজন, (কিছু) সম্পদ ও তার আমল। পরে পরিবারের লোকজন ও সম্পদ ফিরে আসে, সঙ্গে থাকে শুধু আমল। (মুসলিম, হাদিস : ৭৬১৩)</p> <p>কী আশ্চর্য! আমরা দুনিয়ায় গুরুত্ব দিই সেই জিনিসের প্রতি, যা আমাদের রেখে ফিরে আসবে; আর যা আমাদের সঙ্গে কবরে প্রবেশ করবে, তার ব্যাপারে অবহেলা করি!</p> <p><strong>লেখক :</strong> প্রাবন্ধিক ও গবেষক</p>