<p>জীবনধারণের জন্য খাদ্যের বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে প্রয়োজন বিশুদ্ধ খাদ্য, যা দেহে পুষ্টি জোগায়, রোগ প্রতিরোধ করে ও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু উত্পাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি অধিক মুনাফার লোভে মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানে মিশিয়ে চলেছে প্রচুর মাত্রায় কেমিক্যাল, ক্যালসিয়াম কারবাইড, ফরমালিন, আর্টিফিশিয়াল রং, ইউরিয়াসহ বিষাক্ত সামগ্রী। ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি করছে পানীয়। আর প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ এসব খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে জীবন।</p> <p>স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল খাদ্যের ফলে ব্রেনস্টোক, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হওয়াসহ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।</p> <p>যারা খাদ্যে ভেজাল মেশায় কিংবা জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, তারা কি এ সমাজের বাইরের কেউ? তাদের কি শিশু-স্বজন নেই? তারা কি একবারও ভেবে দেখে না, যে খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছি, সাময়িক মুনাফার আশায়, তা হতে পারে আমার জন্যও সর্বনাশা!</p> <p>খাদ্যে ভেজাল একটি অনৈতিক, অমানবিক ও জাতি বিধ্বংসী নীরব গণহত্যা। এসব কোনো মুসলমান ও বিবেকবান মানুষের কাজ নয়। প্রতিনিয়ত ভেজাল খেয়ে সরাসরি রোগাক্রান্ত হয়ে মরছে হাজার হাজার মানুষ। তাই এ কথা বলা যায়, ‘ভেজাল খাদ্য’ নামের নীরব ঘাতকের শিকার লাখ লাখ মানুষ। অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন,  ‘তোমরা পরস্পরকে হত্যা কোরো না’। (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)</p> <p>খাদ্যে ভেজাল ও কারসাজি করে দাম বৃদ্ধি ইসলামে চরমভাবে নিন্দিত, আর তা রমজানে আরো</p> <p>জঘন্য অপরাধ। এতে কয়েক ধরনের অপরাধ জড়িয়ে আছে :</p> <p>(১) প্রতারণা। এটি ইসলামে নিষিদ্ধ। একসময় রাসুলুল্লাহ (সা.) বাজারে এক খাদ্যস্তূপের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপের ভেতরে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ভেতরেরগুলো ভেজা। তখন খাদ্য বিক্রেতাকে বললেন, এটি কেমন কাজ? সে বলল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে হে আল্লাহর রাসুল! রাসুল (সা.) বলেন, তাহলে তুমি ভেজা খাদ্যগুলো ওপরে রাখোনি কেন, যাতে মানুষ দেখতে পেত! অতঃপর নবীজি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমার উম্মত নয়। (মুসলিম, হাদিস : ১০২)</p> <p>তিনি আরেক হাদিসে বলেছেন, ‘যদি পণ্যদ্রব্যের কোনো দোষত্রুটি গোপন করে ও মিথ্যা বলে, তাহলে ব্যবসার বরকত চলে যায়।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯৫২)</p> <p>(২) আত্মসাৎ। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৮) ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত হালাল উপার্জন। হারাম উপার্জনের মাধ্যমে যে রক্ত-মাংস তৈরি হয়, সে রক্ত-মাংসের শরীর দ্বারা কোনো ইবাদত কবুল হয় না। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ওই দেহ জান্নাতে যাবে না, যা হারাম খাবার থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযুক্ত স্থান।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ১৭২৩)</p> <p>অন্যদিকে বৈধ পন্থায় ব্যবসা করা একটি মহৎ পেশা। তাঁদের সম্পর্কে নাবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীরা হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে উত্থিত হবেন।’ কিন্তু যারা খাদ্যে ভেজাল দেবে তারা অসাধু ব্যবসায়ী। তারা মহাপাপী। তাদের সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন (অসাধু) ব্যবসায়ীদের মহাপাপীরূপে উঠানো হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯-১২১০)</p> <p>(৩) বান্দার হক নষ্ট করা। খাদ্যে ভেজালদানকারী মূলত বান্দার হক নষ্টকারী। বান্দার হক নষ্ট করা কবিরা গুনাহ। তা আল্লাহ ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে ক্ষমা করে। একদা নবীজি (সা.) তাঁর পাশে উপবিষ্ট সাহাবিদের বলেন, ‘তোমরা কি জানো, প্রকৃত গরিব কে? সাহাবিরা বলেন, আমাদের মধ্যে তো গরিব তাদের বলা হয়, যাদের কাছে ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা থাকে না। তখন নবীজি (সা.) বললেন, প্রকৃতপক্ষে আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে গরিব সে, যে কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা, জাকাত—সব কিছু নিয়ে উঠবে; কিন্তু সে দুনিয়ায় কারো সঙ্গে মন্দ আচরণ করেছে, কারো নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কাউকে আঘাত করেছে, কাউকে খুন করেছে ইত্যাদি। সেদিন তার নেকিগুলো দিয়েই হকদারদের হক পরিশোধ করা হবে। যদি তার নেকি শেষ হয়ে যায়, তাহলে এই হকদারদের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (বুখারি : ২/৪৩৫)</p> <p>(৪) মিথ্যা। খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার অর্থ হলো সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৪২) কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তিন ব্যক্তির দিকে ফিরেও তাকাবেন না। তাদের একজন হলো—‘যে তার ব্যবসায়িক পণ্য মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১০৬)</p> <p>(৫) শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। খাদ্যে ভেজাল শুধু মানুষের মানসিক ও আর্থিক ক্ষতিই করে না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা মানুষের জীবনও নষ্ট করে দেয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ এবং প্রকৃত মুমিন সে, যার পক্ষ থেকে অন্য মানুষের জান ও মালের কোনো শঙ্কা থাকে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৬২৭)</p> <p>সুতরাং প্রকৃত মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করতে হলে হালাল জীবিকা উপার্জনের বিকল্প নেই।</p> <p>লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।</p> <p> </p>