<p>হাজার বছর ধরে পৃথিবীর ভূ-রাজনীতির ময়দানে তুরস্কের নাম গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত। উসমানি সালতানাতের গোড়াপত্তন হয়েছিল অতিথিসেবায় অনুরাগী উসমান গাজী নামের এক কোরআনপ্রেমীর হাত ধরে। কোরআনপ্রেমিকের হাত ধরে উসমানি খিলাফত, তারপর উসমানি সম্রাটদের ৬২৪ বছর ছিল ইসলামী খিলাফতের ক্ষেত্র। যুগে যুগে এই ঐতিহাসিক দেশটি ইতিহাসের উত্থান-পতনের সাক্ষী। এই দেশ বিশ্বক্ষমতার প্রতিযোগিতার যুদ্ধক্ষেত্র হওয়ার পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর গৌরবোজ্জ্বল অতীতের অনুস্মারক হিসেবে কাজ করেছে। এর বিখ্যাত নিত্যদিনে সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করা দুই মহাদেশের শহর ইস্তাম্বুল, তোপকাপি প্রাসাদ, সুলতান আহমেদ মসজিদ, বসফোরাসে সূর্যাস্তের দৃশ্য আর হাজিয়া সোফিয়ার জন্য পর্যটকদের কাছে যেমন দেশটি গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ইউরোপ আর ভলকান রাষ্ট্রগুলোর বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর সহজতর পথ হিসেবে বসফোরাস প্রণালি ও নানা কারণে এর বাণিজ্যিক গুরুত্বও কম নয়।</p> <p>বসফোরাস প্রণালিটি কলকল বয়ে চলা যেমন ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে যোগসূত্র হয়ে আছে, তেমনি তুরস্কে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির যোগসূত্রের ভূমিকা পালন করেছে। বসফোরাসকে সূর্যাস্তের সময় দর্শকদের কাছে সোনালি মনে হয়। এ দৃশ্য উপভোগ্য। এ ছাড়া প্রিয় নবীজির মদিনায় অতিথিসেবক হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর সমাধি (আয়ুপ সুলতান), ইসলামী স্থাপনাগুলোর সুউচ্চ মিনারগুলো, বিখ্যাত দরবেশ শামস তাবরিজ আর মাওলানা রুমির স্মৃতিধন্য এই তুরস্ক ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতারও বিশেষ গুরুত্ব আছে।</p> <p>উসমান গাজী, সুলতান সুলাইমান আর সুলতান মাহমুদ আল ফাতেহর নাম যেমন এর রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে, তেমনি আতাতুর্কের পর রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও মহানায়কে পরিণত হয়েছেন। গেল ১৫ জুলাইয়ের অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেওয়ার পর বিশ্ব-মিডিয়ায় যেমন এরদোয়ানের নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তেমনি ফেতুল্লাহ গুলেনের নামও উচ্চারিত হচ্ছে বেশ জোরেশোরে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ সমসাময়িক গোটা বিশ্বেই  ফেতুল্লাহ গুলেনকে নিয়ে এক সুপ্ত কৌতূহল। কে এই গুলেন। কোথায় তিনি থাকেন। কোত্থেকে তিনি মুসলিম বিশ্বের সম্ভাবনায় কলকাঠি নাড়ছেন। কেনই বা তিনি নির্বাসনের জন্য পেনসিলভানিয়াকে বেছে নিলেন? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছেই নেই। </p> <p>ব্যর্থ অভ্যুত্থানের আগে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গুলেন অপরিচিত থাকলেও তুরস্কের জনগণের কাছে খুবই পরিচিত ছিলেন। তবে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর গুলেন অনেকটা ‘টক অব দ্য টাইমেই’ পরিণত হন। তাঁকে পূর্ব ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা, ইসলামের সেবক, সমাজসংস্কারকের রোলমডেল হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর মুসলমানদের কাছে ক্রমেই পশ্চিমাদের এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন।</p> <p>ফেতুল্লাহ গুলেনের জন্ম ২৭ এপ্রিল, ১৯৪১ সালে তুরস্কের এরজুম শহরে। ছোটকাল থেকেই অদম্য মেধাবী গুলেন ১৯৪৫ সালে কোরআন শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে হাফিজে কোরআন হওয়ার পর তুরস্কের বড় বড় শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেন। আধুনিক সমাজ ও ভৌতবিজ্ঞান অধ্যয়ন করলেও জনপ্রিয়তার জন্য ধর্ম প্রচারকেই বেছে নেন। ১৯২৪ সালে কামাল পাশার হাতে উসমানি খিলাফত ধ্বংস হওয়ার পর ইসলামের প্রচার-প্রসার বন্ধ হয়, বন্ধ হয় অনেক মসজিদ-মাদ্রাসা। কিন্তু কামাল পাশা তুরস্কের মানুষের হৃদয় থেকে ইসলামী চেতনা মুছতে পারেননি। তুরস্কের সাধারণ মানুষের দ্বীনের প্রতি যে শূন্যতা তৈরি হয়, তাকে কাজে লাগিয়ে মুহূর্তেই জনপ্রিয়তা লাভ করতে ওয়াজ-নসিহতকেই পুঁজি করেন। ১৯৫৯ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তিনি তৎকালীন সরকার কর্তৃক নিয়োজিত ধর্মপ্রচারক হিসেবে যোগদান করেন। তৎকালীন সেক্যুলার সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সব নির্দেশনাই তিনি অকাতরে মেনে চলতেন।</p> <p>উসমানি খিলাফতের পতনের পর আলেম-ওলামাদের ওপর দমন-পীড়নের কারণে ধর্মীয় অঙ্গনে সৃষ্টি হওয়া শূন্যতাকে কাজে লাগাতে আবেগঘন ওয়াজকে তিনি অবলম্বন হিসেবে বেছে নেন। তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইজমিরে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। শিক্ষা, গণমাধ্যম ও আন্তধর্মীয় সংলাপের মতো বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশ-বিদেশে তৌহিদি জনতার নজর কাড়েন। তাঁর আন্দোলনের অংশ হিসেবে তুরস্কে প্রতিষ্ঠা করেন তিন শতাধিক স্কুল। তুরস্কের কয়েকটি নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক তিনি। পৃথিবীর ১৮০টি দেশে সহস্রাধিক স্কুল রয়েছে এই মুভমেন্টের অংশ হিসেবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তুর্কি ও ইংরেজি ভাষার কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম রয়েছে তাঁর মুভমেন্টের অধীনে। তুরস্কের সর্বাধিক প্রচারিত (প্রায় ১০ লাখ সার্কুলেশন) পত্রিকা ‘আল জামান’ ছিল তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। ২০টিরও বেশি ম্যাগাজিন বের করেন তিনি। এর মধ্যে একটি ম্যাগাজিন তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিনের জায়গা দখল করে আছে। প্রতি মাসে ৮০ হাজারেরও বেশি কপি বিক্রি হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ইসলামাইজেশনের মোড়ক লাগানো থাকলেও এর অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের ভেতরে সেক্যুলারিজমের বীজই তিনি বপন করে দিচ্ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে পরিচালিত হয় তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। তাঁর কর্মীরা এতটাই গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেন যে কে গুলেনপন্থী আর কে গুলেনন্থী নয়, তা বোঝার উপায় নেই। নব্বইয়ের দশকে আন্তধর্মীয় সংলাপ তাঁর মুভমেন্টকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। তুরস্কের কট্টর সেক্যুলাররাও জনগণের আনুকূল্য পেতে ইসলামের বিকল্প হিসেবে গুলেনের বক্তব্যের কৌশল অবলম্বন করেন।</p> <p>এরই মধ্যে ইসলামের কারণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভকারী এই তুখোড় মেধাবী ‘ধর্মীয় নেতা’ সময়ের ব্যবধানে ইহুদি ও পশ্চিমাদের নজরে পড়েন। তাঁর মিশন যেন আরো সহজ হয়ে পড়ে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এসেই ফেতুল্লাহ গুলেনের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আসল চেহারা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ১৯৯০ সালের পর থেকে তার গুলেন মুভমেন্টের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তি কলকাঠি নাড়ছে। একপর্যায়ে তিনি ইহুদি ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের নজরে পড়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এফবিআই (Federal Bureau of Investigation) ২০০৫ সালে নিজেদের ওয়েবসাইটে তাদের সহযোগী সংস্থাগুলোর তালিকায় ৪ নম্বরে ‘দ্য গুলেন মুভমেন্টকে’ স্থান দেয়। </p> <p>কৌশলগত কারণে আন্দোলন প্রকাশ্যে অরাজনৈতিক হলেও এর ভেতরে তিনি শক্তিশালী রাজনৈতিক বলয় তৈরি করেছেন। বর্তমানে গুলেনপন্থীরাই তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি। রাজনৈতিকভাবে তিনি কখনো ইসলামিস্টদের সমর্থন করেননি। ১৯৯৬ সালে ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকানের রেফাহ পার্টি ক্ষমতায় আসার পর অর্ধশতাব্দী ধরে ‘সেক্যুলারদের’ জাঁতাকলে পিষ্ট তুরস্কবাসীর প্রত্যাশার সূর্যোদয় হয়। ড. এরবাকান তুরস্কের ইসলামপন্থীদের সমর্থন পেলেও গুলেনের কাছ থেকে তিনি তা পাননি। এরবাকান মুসলিম উম্মাহর জন্য কাজ শুরু করলে ইসরায়েলসহ সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীরা কিছুতেই তা ভালো চোখে দেখেনি। মিসরের ড. মুরসির মতোই হয়েছিল এরবাকানের পরিণতি। ইহুদিবাদীরা এরবাকানকে ক্ষমতাচ্যুত করার যে আগুন জ্বালিয়েছিল, তাতে গোপনে পেট্রল ঢেলেছিলেন ফেতুল্লাহ গুলেন। এরবাকান প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনেও অভিযোগের তীর গুলেনের দিকেই। সে সময় হিজাবের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি হলে এর বিরোধিতা তো করলেনই না, বরং হিজাবের মতো ধর্মীয় মৌলিক অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তাঁর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অধিকন্তু তাঁর কথিত মুভমেন্টের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর মেয়েদের হিজাব খুলে ক্লাস করার জন্য বলা হলো।</p> <p>তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী না হলেও গোপনে (আন্ডারগ্রাউন্ড) কাজ করার পক্ষপাতী। তাঁর দর্শন মতে, মেয়েদের হিজাব বিসর্জন দেওয়াই উচিত। তাঁর মুভমেন্ট পরিচালিত স্কুলের ১৫-১৬ বছর বয়সী যুবতীদের নিয়ে প্রতিবছর তার্কিশ অলিম্পিয়াডে নাচ-গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাই পশ্চিমা মিডিয়া ও বিভিন্ন সংস্থার কাছে তিনি যেন হিরো। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিন ও যুক্তরাজ্যের ‘প্রসপেক্ট’ নামের ম্যাগাজিন তাদের একটি সিটিজেন জরিপের মাধ্যমে ফেতুল্লাহ গুলেনকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। (দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস : ১০-০৭-২০০৮)</p> <p>অনেকের মনেই প্রশ্ন, কেন গুলেন স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গেলেন? তুরস্কের জনগণ যেহেতু ইসলামী চেতনা হৃদয়ের গভীর থেকেই লালন করে, তাই ইসলামী সংস্কারকের অভিনয়ের আড়ালে তাঁর আসল চরিত্র যেদিন তুরস্কের জনগণের কাছে ধরা পড়ে যাবে, সেদিন তুরস্ক আর তাঁর জন্য নিরাপদ থাকবে না—এ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি তা পেয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি অধ্যুষিত এলাকা পেনসিলভানিয়ায় তিনি ১৯৯৯ সালে ‘স্বেচ্ছায় নির্বাসন’ গ্রহণ করেন। এরপর কার্যতই তিনি ইহুদি ও পশ্চিমাদের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হন। ইহুদিদের এজেন্ট হয়ে মুসলিমদের স্বার্থের বিপরীতে তিলেতিলে জনমত তৈরি ও শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলার কাজটিই তিনি মার্কিন মুলুকের পেনসিলভানিয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছেন।</p> <p> </p> <p>লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ বোর্ডবাজার (আ. গনি রোড), গাজীপুর</p> <p>jubayer.ahmad93@gmail.com</p>