স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সংস্কারের এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা পুরো প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করব। নাগরিক, বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট সবাই যাতে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারেন, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।’
গতকাল রবিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার হাতে এই প্রতিবেদন তুলে দেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘এই সংস্কারগুলো শুধু পড়ার জন্য নয়; আমার বিশ্বাস, এগুলো স্কুলের পাঠ্যক্রমেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে ওঠে।
’
প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, আর দেরি নয়, এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের পথে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে।
কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পরামর্শ, গবেষণা এবং মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষে তাঁরা এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনের প্রথম অংশে রয়েছে কাঠামোগত সংস্কার আর শেষের দিকে আমরা তুলে ধরেছি এমন একটি মূলধারার চিন্তা, যেটি অনুসরণ করলে হাজারো কার্যকর পরিবর্তন একসঙ্গে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরো দক্ষ ও আধুনিক করে গড়ে তোলা।
’
প্রতিবেদনে শহরভিত্তিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর চ্যালেঞ্জগুলোর কথাও গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ করে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুর্বলতা।
তিনি বলেন, বিভাগীয় অদক্ষতা এবং ঘুষ-দুর্নীতি এখনো বড় সমস্যা। বড় প্রকল্প থেকে শুরু করে সাধারণ সেবা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির ছাপ রয়েছে। প্রকল্প পর্যায়ে, সেবা পর্যায়ে এবং বিভিন্ন বিভাগীয় স্তরেও দুর্নীতি ছড়িয়ে আছে।
এগুলো সমাধান না করলে ভালো শাসনব্যবস্থা শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
এই বৈঠকে কমিশনের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক ফেরদৌস আরফিনা ওসমান, আবদুর রহমান, ড. মাহফুজ কবির, মহসুদা খাতুন শেফালী, অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, এলিরা দেওয়ান, অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, এ কে এম তারিকুল আলম, হেলেনা পারভীন ও মজবাহ উদ্দিন খান।
পরে সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রতিবেদন দাখিল-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংস্কার না করে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার—কোনো নির্বাচন করেই ভালো ফল পাওয়া যাবে না।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, মাত্র ৪০ দিনের একটি শিডিউলে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করা সম্ভব।
বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে ২২৫ দিন লাগে। খরচ হয় দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা। একটি শিডিউলে খরচ নেমে আসবে ৭০০ কোটি টাকায়।
সুপারিশে যা আছে
সুপারিশে বলা হয়েছে, গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের তিনটি স্তর ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ এবং নগর স্থানীয় সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন বহাল থাকবে।
স্থানীয় সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে একটি সহজ, স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমজাতীয় গণতান্ত্রিক সংগঠনকাঠামো প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়। এই কাঠামোগুলো অধ্যাদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে অবিলম্বে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয় সুপারিশে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক পাঁচটি আইন রয়েছে। রয়েছে শতাধিক অধস্তন আইন এবং অসংখ্য বিধি ও প্রজ্ঞাপন। এই আইনের জাল স্থানীয় সরকার কার্যকরের একটি প্রধান বাধা। তাই কমিশন এই পাঁচটি আইনকে একটি সমন্বিত আইনে একীভূত করার সুপারিশ করছে। একীভূত আইন অধ্যাদেশ আকারে জারি হলে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন একটি সুবিধাজনক ও যৌক্তিক সময়ে অনুষ্ঠান করা যায়। তবে একক তফসিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে একটি অধ্যাদেশ বা আইনের মাধ্যমে বিদ্যমান সব স্থানীয় সরকার সংস্থা বিলুপ্ত করতে হবে।
এতে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদের জনসংখ্যা ও আয়তনের ভিত্তিতে ওয়ার্ডের সংখ্যা পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ চার লাখ ৭৫ হাজার থেকে সর্বনিম্ন প্রায় পাঁচ হাজার জনগোষ্ঠী পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ক্ষেত্রে ওয়ার্ডের সীমানা ও জনসংখ্যা পুনর্নির্ধারণ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। তাই প্রতিটি ওয়ার্ডে জনসংখ্যা এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ জন ধরে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে সর্বনিম্ন ৯টি থেকে সর্বোচ্চ ৩৯টি পর্যন্ত ওয়ার্ড হতে পারে।
উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচনের সুবিধার্থে উভয় পরিষদের ওয়ার্ড পদ্ধতি কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা পরিষদের তিনটি ওয়ার্ড হিসেবে পরিগণিত হবে এবং একটি উপজেলা জেলা পরিষদের তিনটি নির্বাচনী ওয়ার্ডে বিভক্ত হতে পারে।
ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদগুলোর এক-তৃতীয়াংশ ওয়ার্ড নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং তা ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে তিনটি নির্বাচনে সম্পূর্ণ হবে। এ ঘূর্ণায়মান নারীর সংরক্ষিত ওয়ার্ড ব্যবস্থা আগামী তিন নির্বাচনের পর পুনর্মূল্যায়ন হতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে কর্মরত দুটি প্রকৌশল অধিদপ্তর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে একত্র করার কথা বলা হয় সুপারিশে।
উপজেলা পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন সিনিয়র সহকারী জজের পদায়নের মাধ্যমে এডিআর আদালত স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, সালিসব্যবস্থাকে এডিআর অফিসারের তত্ত্বাবধানে আনতে হবে। কোনো সালিসে আপস-মীমাংসা না হলে এডিআর অফিসার তার আপিল শুনবেন। এডিআর অফিসার সালিস ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান ও সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যত দিন পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ আদালত প্রতিষ্ঠিত না হয়, তত দিন পর্যন্ত গ্রাম আদালত ব্যবস্থা বহাল থাকবে।
ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকে কার্যকরভাবে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংযুক্ত করার উপায় হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে অনুমোদিত জনবল সম্পূর্ণভাবে পদায়নের জন্য কমিশন সুপারিশ করেছে।