<p>২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের ৪০.৮৬ শতাংশ পেয়ে বিএনপি আসন পেয়েছিল ১৯৩টি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৬২টি আসন পেয়েছিল। অথচ দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশনাল (পিআর) বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু থাকলে সেবার ফল হতো ভিন্ন। এ ব্যবস্থায় ওই নির্বাচনে বিএনপি ১২২টির কাছাকাছি আর আওয়ামী লীগ কমপক্ষে ১২০টি আসন পেত। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলগুলোর আসন প্রাপ্তি সামঞ্জস্য ছিল না। ওই নির্বাচনে ৪৮.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন লাভ করেছিল। অন্যদিকে বিএনপি ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৩০টি। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন পদ্ধতি থাকলে বিএনপি আসন পেত কমপক্ষে ৫৭টি।</p> <p>সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় ভোটাররা ব্যক্তিকে নয়, দলকে ভোট দেন। দলের ভোট প্রাপ্তির হারের ওপর ওই দল কত আসন পাবে তা নির্ভর করে। ইউরোপের প্রায় সব দেশ এবং পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে এই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা চালু করা হলে নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম কমে আসবে। সেই সঙ্গে একটি দল প্রকৃত অর্থেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে বলে মনে করেন অনেক রাজনীতিক ও বিশিষ্টজন। এ ব্যবস্থায় মাত্র কয়েক শতাংশ ভোট কম-বেশি হওয়ার কারণে সংসদে আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান সৃষ্টি হবে না।</p> <p>অন্যদিকে দেশে বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ ব্যবস্থায় অনেকে বিনা ভোটেই নির্বাচিত হচ্ছেন। কোথাও আবার প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকরও কম ভোট পেয়ে নির্বাচিত হচ্ছেন বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের ভোট না পেয়েও তাদের প্রতিনিধি হতে পারছেন।</p> <p>বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদ ও জাতীয় পার্টিসহ বেশ কিছু দল বিদ্যমান ব্যবস্থার বদলে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার পক্ষে। বড় দলগুলোরও কোনো কোনো নেতা এই ব্যবস্থাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও এ পদ্ধতির সমর্থক রয়েছেন। যদিও নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখনো এ ধরনের পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাব দিতে পারেনি। ইসির ধারণা, এ পদ্ধতির পক্ষে ব্যাপকভাবে জনদাবি উত্থাপন না হলে প্রস্তাবে সুফল মিলবে না।</p> <p>২০১৫ সালের এপ্রিলে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের তখনকার উপদেষ্টা (বর্তমানে দলের ভাইস চেয়ারম্যান) ইনাম আহমেদ চৌধুরী ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন পদ্ধতির বিষয়ে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ সংলাপে জানতে চান, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুসারে জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টনের পদ্ধতি বাংলাদেশেও চালু করা উচিত কি না। জবাবে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘এ পদ্ধতি চালু করতে হলে যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সহনশীলতা দরকার। পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা দরকার কারণ পদ্ধতিটি খারাপ নয়। ভালো বলেই অনেকে গ্রহণ করেছেন।’ ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘পদ্ধতিটি চালু করা দরকার। কারণ এখন যারা জেতে তারাই সব নিয়ে নেয়। শুরু হয় বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন। এখানে দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য নেই। সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব আমাদের দেশেই বেশি প্রযোজ্য।’</p> <p>সংলাপে আলোচক সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এ পদ্ধতিটি একটি উপায়, যার মাধ্যমে দ্বিদলীয় পদ্ধতি থেকে বের হতে পারে। তবে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন। ভোটারদের বোঝাতে প্রচুর সময় লাগবে। তবে এটি আধুনিক গণতান্ত্রিক একটি পদ্ধতি।’ অন্য আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েনও বলেন, ‘জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে পদ্ধতিটির দিকে এগোতে হবে।’</p> <p>সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থাও কয়েক রকমের। শুধু দলকে ভোট দেওয়া ছাড়াও ‘পার্টি লিস্ট’ পদ্ধতিতেও ভোটাররা দলের প্রার্থী নির্ধারণ করার সুযোগ পান। এ পদ্ধতিতে দলগুলো তাদের প্রার্থী তালিকা দিয়ে দেয়। ভোটাররা দল পছন্দ করার পাশাপাশি দলের কোন প্রার্থীকে চান সেটাও পছন্দ করে দিতে পারেন। অনেক দেশে মিশ্র পদ্ধতিও চালু আছে। এই পদ্ধতিতে মোট আসনসংখ্যার ৫০ শতাংশ নির্বাচিত হয় সাধারণ পদ্ধতিতে, বাকি ৫০ শতাংশ নির্বাচিত হয় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভোটিং ব্যবস্থায়।</p> <p>নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ধারাবাহিক সংলাপে অংশ নিয়ে সিপিবি গত ৫ জানুয়ারি ইসি গঠন, নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনব্যবস্থার আমূল সংস্কারের জন্য ৫৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরে। এর মধ্যে ইসি নিয়ে ছিল সাত দফা সুপারিশ। এ ছাড়া দেশে প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথা বলেছে দলটি। এ জন্য ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে ৪৪টি সুপারিশ দিয়েছে সিপিবি। সিপিবির বক্তব্য হলো, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ওপর নির্ভরশীল না করে গোটা প্রক্রিয়াটি একটি আইনগত কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এ জন্য ‘সিলেক্ট কমিটি’ গঠনের পদ্ধতি নির্ধারণসহ সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারার নির্দেশনা অনুযায়ী উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা উচিত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য অত্যাবশ্যক শর্ত হলো একটি স্বাধীন, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, পেশাদার, দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এ কথাটিও সত্য যে, ‘প্রয়োজন’ হলেও সেটুকুই তার জন্য ‘যথেষ্ট’ নয়। তার জন্য সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো—গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজানো। প্রয়োজন, ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।”</p> <p>ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষেও রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া সাত দফা প্রস্তাবের একটিতে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে বলা হয়।</p> <p>নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইসির সঙ্গে সংলাপেও সিপিবির লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, “নির্বাচনে নিরপেক্ষতা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। শ্রেণি বিভক্ত ও বৈষম্যপূর্ণ একটি সমাজে পরিপূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অথবা ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ আশা করা যায় না। এই মৌলিক বিবেচনার পরও নির্বাচনকে আপেক্ষিকভাবে হলেও অন্তত সেটুকু অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে হবে যাতে চলতি জনমতের প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচনের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হলে অন্তত এটুকু প্রয়োজন। কিন্তু সেটুকু নিশ্চিত করতে গেলে বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম করণীয় হচ্ছে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা প্রবর্তন। এ ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদের নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত কাজকর্ম সম্পর্কে প্রস্তাবনা-পরিকল্পনা-কর্মসূচি-নীতি বর্ণনা করে রাজনৈতিক দলগুলো দেশবাসীর সামনে নিজ নিজ ইশতেহার উপস্থিত করবে। দেশবাসী এসব ইশতেহারের মধ্য থেকে যে দলের ইশতেহারে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাবে, সেই দলের মার্কায় ভোট দেবে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে দল জাতীয় সংসদে সেই সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাবে। অর্থাৎ মোট আসন যদি ৩০০ হয়, তাহলে কোনো দল ৫০ শতাংশ ভোট পেলে ১৫০টি আসন পাবে। ঐকমত্যের প্রয়োজনে নতুন ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থাও আংশিকভাবে (অর্ধেক আসনে) অব্যাহত রাখা যেতে পারে। সবার মতামতের ভিত্তিতে এই অনুপাত কম-বেশিও করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় সংসদ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কাজে দলীয় প্রধানের বা নেতৃত্বের কোটারির স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করার জন্য দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা বিধিবদ্ধভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে।”</p> <p>ওই সংলাপে বিকল্প ধারা বাংলাদেশও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ জাতীয় সংসদের আসন ৪০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। দলটির পক্ষে বলা হয়েছিল, ‘এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন দলের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ যাঁরা জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম অথচ আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নির্বাচনে অপারগ, তাঁদের রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে আনার সুযোগ পাবে।’</p> <p>২০১১ সালে ইসির সঙ্গে সংলাপে সিপিবি ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল একই প্রস্তাব রেখেছিল। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৩৫০টি করার প্রস্তাবসহ বলা হয়েছিল, ‘দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন (প্রার্থীকে নয়, দলকে ভোট) করে ভোটের ভিত্তিতে দলের সংসদ সদস্য নির্বাচন করা এবং দলের কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যু হলে উপনির্বাচন না করে বরং সংশ্লিষ্ট দলের প্রার্থী তালিকা থেকে সংসদ সদস্য ঘোষণা করার ব্যবস্থা রাখতে হবে।’</p> <p>সে সময় তত্কালীন সিইসি ড. এ টি এম শামসুল হুদা এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এটা হলে নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব কমবে। আবার কিছু অসুবিধাও রয়েছে। আপনারা এ দাবি অব্যাহত রাখেন। এক সময় হয়তো বিষয়টি সবার ওপর আছর করতে পারে।’</p> <p>নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপের প্রধান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের এখন একটাই পথ রয়েছে। তা হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন ব্যক্তিভিত্তিক না করে দলভিত্তিক বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা করা। এতে নির্বাচনী অনিয়ম অনেকাংশে কমে আসবে। বিশ্বের অনেক দেশে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে সেই অনুপাতে তারা সংসদে আসন পাবে।</p>