সারমর্ম
১। পরের সুখে শেখা বুলি পাখির মতো কেন বলিস?
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মতো কেন চলিস?
তোর নিজস্ব সর্বাঙ্গে দিলেন ধাতা আপন হাতে।
মুছে সেটুকু বাজে হলি, গৌরব কি বাড়ল তাতে?
আপনারে যে ভেঙেচুরে গড়তে চায় পরের ছাঁচে,
অলীক, ফাঁকি মেকি সেজন নামটা তার কদিন বাঁচে?
পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যারে,
খাঁটি ধন যা সেথায় পাবি, আর কোথাও পাবি নারে।
সারমর্ম : পরাণুকরণ ও পরাণুসরণে কোনো গৌরব নেই।
তাই সার্থক জীবনের লক্ষ্যে সবার মিলেমিশে বেঁচে থাকা উচিত।
৩। সবারে বাস রে ভালো
নইলে মনের কালো মুছবে না রে।
আজ তোর যাহা ভালো
ফুলের মতো দে সবারে।
করি তুই আপন আপন,
হারালি যা নিজ আপন,
বিলিয়ে দে তুই যারে তারে।
যারে তুই ভাবিস ফণী,
তারো মাথায় আছে মণি,
বাজা তোর প্রেমের বাঁশি
ভবের বনে ভয় বা কারে?
সবাই যে তোর মায়ের ছেলে
রাখবি কারে, কারে ফেলে?
একই নায়ে সকল ভায়ে
যেতে হবে রে ওপারে।
সারমর্ম : নিজেকে নিয়ে বিভোর হতে গিয়ে অন্যকে দূরে ঠেললে মানুষ হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ। আর নিঃসঙ্গ জীবনে কখনোই প্রকৃত সুখ উপলব্ধি করা যায় না। সবাই মিলেমিশে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে আত্মীয়তার বন্ধনে একত্র থাকার মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। সমগ্র মানবজাতিই পরস্পর আত্মার নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। জীবনকে সার্থক ও মহীয়ান করতে হলে মানুষে মানুষে চাই প্রীতি ও প্রেমের মেলবন্ধন। কারণ পৃথিবীতে আমরা মানবরূপে জন্মগ্রহণ করেছি, আবার একই পথে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের লোকান্তরিত হতে হবে। সুতরাং মনের কালিমা মুছে ফেলে সবাইকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করাই মহত্ত্ব।
৪। দৈন্য যদি আসে, আসুক, লজ্জা কি বা তাহে,
মাথা উঁচু রাখিস।
সুখের সাথী মুখের পানে যদি নাহি চাহে,
ধৈর্য ধরে থাকিস।
রুদ্র রূপে তীব্র দুঃখ যদি আসে নেমে,
বুক ফুলিয়ে দাঁড়াস,
আকাশ যদি বজ্র নিয়ে মাথায় ভেঙে পড়ে,
ঊর্ধ্বে দু হাত বাড়াস।
সারমর্ম : মানবজীবন সংগ্রামে ভরপুর। তাহলেও এ জীবনের দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে কোনো লজ্জা নেই, বরং কারো মুখাপেক্ষী হওয়ার মধ্যেই লজ্জা। ধৈর্য ও সাহস নিয়ে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতময় পথ অতিক্রম করতে হয়। দুঃখ-দৈন্যের সঙ্গে লড়াই না করে এবং বিপদকে মোকাবেলা না করে জীবনে সাফল্য অর্জিত হয় না। তাই বিপদে ধৈর্য ধারণ করে দুঃখ-দারিদ্র্যকে সাহস ও মনোবল দিয়ে প্রতিহত করতে পারলে জীবনে সাফল্য লাভ করা যায়।
৫। ধন্য আশা কুহকিনী! তোমার মায়ায়
অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি;
দাঁড়াইত স্থিরভাবে চলিত না, হায়
মন্ত্র বলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি।
ভবিষ্যৎ অন্ধ মূঢ় মানব সকল
ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল-আকার;
তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ, পেয়ে তব বল
যুঝিছে জীবন যুদ্ধে হায় অনিবার।
নাচায় পুতুল যেমন দক্ষ বাজিকরে,
নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।।
সারমর্ম : জীবন সংসারে আশাই মানুষের অদৃশ্য চালিকাশক্তি। আশার ছলনায় পড়ে মানুষ সংসারের মায়া-মমতায় জড়িয়ে আছে; সংসারের ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হচ্ছে, প্রতারিত হচ্ছে বারবার। কিন্তু তার পরও আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আশা না থাকলে মানুষ চলার শক্তি হারিয়ে একেবারে নিশ্চল হয়ে যেত। আশার জাদুতেই মানুষ নানা সংকট ও প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে, মঙ্গল ও সমৃদ্ধির আশায় কাজ করে যায় সারা জীবন। আশাই মানুষের মনে প্রাপ্তির প্রত্যাশা জাগায় এবং তাকে পুতুলের মতো নাচায়।
৬। ‘বসুমতী, কেন তুমি এতই কৃপণা?
কত খোঁড়াখুঁড়ি করি পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয় দে মা প্রসন্ন সহাস,
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?
বিনা চাষে শস্য দিলে কী তাহাতে ক্ষতি?’
শুনিয়া ঈষৎ হাসি, কন বসুমতী,
‘আমার গৌরব তাতে সামান্যই বাড়ে;
তোমার গৌরব তাহে একেবারেই ছাড়ে।’
সারমর্ম : মানুষের উন্নতির মূলে রয়েছে শ্রমবৃত্তি। করুণার দান কিংবা ভিক্ষার দানকে গ্রহণ করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই, বরং তা লজ্জার ও অসম্মানের। তাই মানুষের শক্তি, সামর্থ্য ও শ্রমের এত মূল্য। শ্রমবিমুখ মানুষ এই পৃথিবীর সব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়। সুকঠিন শ্রম ও কর্মসাধনায় কোনো জিনিস লাভ করলে তাতে গৌরব ও আত্মতৃপ্তি দুই-ই পাওয়া যায়। পরিশ্রমই মানুষের অস্তিত্বের অবলম্বন ও মর্যাদার কষ্টিপাথর।