রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেমনি মানবজীবনের বিভিন্ন দিক, ওঠা-বসা, চলাফেরা, শোয়া ও জাগ্রত হওয়া, পানাহার এবং জীবনের অন্যান্য 'আমলি' বিষয়- 'আদব'-শিষ্টাচার ও বিধিবিধানের শিক্ষা প্রদান করেছেন এবং নিজের অমূল্য বাণী ও সুন্দর আমল দ্বারা মুসলিম উম্মাহকে সরল পথের সন্ধান দিয়েছেন। এটি হালাল, এটি হারাম। এটি জায়েজ এবং এটি নাজায়েজ। এ কাজটি উত্তম এবং এ কাজটি অনুত্তম।
গোড়ালির নিচে কাপড় পরিধান ও আজকের সমাজ
মোহা. শরফুদ্দীন আল আযীযী

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, লুঙ্গি (পায়জামা-প্যান্ট) ইত্যাদির যে অংশ টাখনুর নিচে হবে, তা দোজখে যাবে। (বুখারি শরিফ, খ. ২, পৃ. ৮৬১)
হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি অহংকারের বশীভূত হয়ে নিজের কাপড় অত্যন্ত নিচে [টাখনুর নিচে] পরিধান করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত দিবসে তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। [বুখারি শরিফ, খ. ২, পৃ. ৮৬০]
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে শুনেছি, মুমিন বান্দাদের জন্য পায়জামা পরিধান করার (উত্তম ও সুন্দর) পদ্ধতি হলো 'নিছফ্ সাক্ব'- অর্ধহাঁটু পর্যন্ত পরিধান করা। অর্থাৎ পায়ের গোছার মধ্যখান পর্যন্ত বা অর্ধহাঁটু অথবা পায়ের গিঁটের মধ্যখান পর্যন্ত হলে গুনাহ হবে না, তা বৈধ।
এসব হাদিসের ওপর গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, অহংকার ও বড়ত্বের পোশাক পরিধানকারীদের ওপর কঠোর ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। কিয়ামত দিবসে, যেদিন সব মানুষ আল্লাহ তায়ালার রহমতের দৃষ্টির প্রতি খুবই মুখাপেক্ষী ও অত্যন্ত প্রত্যাশী থাকবে, সেদিন তারা তাঁর রহমতের দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.)-এর হাদিস থেকে অনুভূত হয়, মুমিনদের জন্য উত্তম হলো লুঙ্গি বা পায়জামা 'নিছফ্ সাক্ব'- অর্ধহাঁটু হওয়া। তবে পায়ের গিঁট পর্যন্ত পরিধান করা বৈধ। কিন্তু তারও নিচে পরিধান করা বৈধ নয়; বরং বড় গুনাহ, তার ওপর জাহান্নামের হুকুম এসেছে। (মারেফুল হাদিস, পৃ. ২৯০, খ. ২)
বর্তমান মুসলিম সমাজে লেবাস-পোশাকের চিত্র খুবই নাজুক। সাধারণ মানুষ ও সাধারণ শিক্ষায় প্রভাবিত লোকদের অবস্থাও বড় হতাশাব্যঞ্জক। তাদের লেবাস-পোশাক বিজাতীয়দের সঙ্গে এমন সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যশীল হয়ে পড়েছে যে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে পার্থক্য ও পরিচয় করাও মুশকিল হয়ে পড়ছে।
বর্তমান প্রচলিত পোশাক, শার্ট-প্যান্টের অবস্থা এই যে যারা এগুলো পরিধান করে, তাদের যেন অবশ্যই পায়ের গোড়ালি আবৃত করতেই হবে। যদিও দীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো কোনো লোককে নামাজ ইত্যাদি আদায়কালে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায়; কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ এর প্রতি কোনো ধরনের ভ্রূক্ষেপও করে না। এমনকি তাতে গুনাহ হয়, এমন অনুভূতিও তাদের নেই। তারা নিজেদের পরনের কাপড় যেভাবে আছে (হাফ হাতার জামা ও গোড়ালির নিচে পায়জামা) সেভাবেই নামাজ আদায় করে। তাদের নামাজের কী হুকুম বা তাদের এই আমলের মান কতটুকু, সেদিকে তাদের কোনো লক্ষ নেই।
এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম)-এর পবিত্র বাণী ও তাঁর মূল্যবান ইরশাদগুলো কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়; বরং তা সর্বজনীন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম)-এর আদর্শ নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সব মুসলমানের নৈতিক দায়িত্ব এবং তা তাদের জন্য সৌভাগ্যের সোপান।
অবশ্যই ইসলামী শিক্ষার মাদ্রাসাগুলো দীনের মারকাজ ও কেন্দ্র। মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী এবং প্রিয় ছাত্রদের সাধারণ মুসলমানরাও আদর্শ ও অনুকরণীয় মনে করে। সুতরাং আমরা যারা মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের অবশ্যই দীনের সব বিষয়ে অনেক সতর্ক ও সচেতন হওয়া একান্ত কর্তব্য।
এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না যে মানুষের মধ্যে মানবতা, দীনি মেজাজ ও দীনি রং এবং শরিয়তের ওপর দৃঢ়তা ও মজবুতি এবং দীনের মহত্ত্ব ও বড়ত্ব কোনো 'সাহেব দিল' অন্তরের অধিকারী বুজুর্গ আলেমে দীনের সঙ্গে সম্পর্ক ও তাঁর সুহবত-সংস্রবে ধন্য হওয়ার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। যেমন বলা হয়, বই-পুস্তক, ওয়াজ-নসিহত এবং ধনসম্পদ দ্বারা দীন আসে না। দীন আসে বুজুর্গদের সংস্রব ও সুদৃষ্টি দ্বারা। আমি [লেখক মাওলানা মীর যাহেদ মিখয়ালভী] যখন ইবতেদায়ি ফারসিখানায় হজরত মুফতি মেহেরবান আলী শাহ বড়োতি (রহ.)-এর মাদ্রাসা 'হারসুলি'তে ভর্তি হলাম, তখন হজরতজি (রহ.)-কে খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে সদা সুন্নাতের পাবন্দ পেলাম। তিনি নিজের ছাত্র ও অধীনস্থদের শুধু কথা দিয়ে নয়, বরং আমলি পদ্ধতি দ্বারাও সংশোধন করতেন। যেমন- আমি কখনো তাঁর পায়জামা 'নিছফ সাক্ব' অর্ধহাঁটুর নিচে দেখিনি। একদা ইছলাহি মজলিসে 'গোড়ালির নিচে কাপড় পরিধান' সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, কোনো একসময় এক সাহেবের মোটরসাইকেলে চড়ে 'শাহ্পুর' থেকে 'হারসুলি'র উদ্দেশে রওনা হলাম। 'কাকড়া' [যা একমাত্র অমুসলিমদেরই পল্লী] পর্যন্ত পৌঁছার পর মোটরসাইকেল নষ্ট হয়ে গেল। তখন সেই সাহেব মোটরসাইকেল ঠিক করতে লাগলেন। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় এক অমুসলিম বৃদ্ধ ধীরগতিতে আমার দিকে ছুটে আসেন। শান্ত আওয়াজে আমাকে বলেন, ওগো। কিছু মনে না করলে একটি কথা জানতে চাই? আপনি পায়জামা অত ওপরে কেন পরিধান করলেন? তিনি যেহেতু অমুসলিম ছিলেন, তাই তাঁকে তো শরিয়ত ও সুন্নাতের কথা বলা যাচ্ছে না। তাঁকে বোঝানোর জন্য বললাম, বেশি নিচে পরিধান করলে কাপড় কাদাযুক্ত হয়ে যায়, এই কাপড় পরিধান করেই নামাজ পড়তে হয়, তাই উঁচু করে পরিধান করলাম। এই কথাটি তাঁর বোধগম্য হয়ে গেল।
নিজেদের এই কাহিনী শুনিয়ে হজরতজি বলেন, যখন দৃঢ়তা ও মজবুতি এসে যায়, তখন কোনো জিনিস তার জন্য প্রতিবন্ধক হয় না। এটি ভেতরের রোগ, মানুষ মনে করে উঁচু করে পায়জামা পরিধান করলে মানুষ আমাকে কী বলবে? আমাকে নিয়ে যদি মানুষ উপহাস করে? কিন্তু বাস্তবতা হলো এই, মানুষ যেকোনো বিষয়ে যখন নিষ্ঠা ও ইখলাস নিয়ে চলতে থাকেন, তখন কেউ তাঁকে মন্দ বলার সাহস করবে না। বরং ভদ্রলোকেরা অবশ্যই তাঁকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখবে।
হজরতজি (রহ.)-এর এক মুরিদের ঘটনা : একদা এক বেদয়াতি এলাকার মসজিদ কমিটি রমজানে কোরআন শোনানোর জন্য তাঁকে নির্বাচন করেন। যখন মসজিদে মুসল্লিরা ওই মুরিদকে দেখেন, তখন তাঁর পোশাক, বিশেষত পায়জামা দেখে তাঁকে কোরআন শোনা থেকে বারণ করেন।
মুফতি একজন দীনের দায়ী হিসেবে তাঁকে হারাম বা নাজায়েজ বলার পাশাপাশি তার বিকল্প হালাল বা জায়েজ পদ্ধতিও বলে দিতে হবে। তাই কোরআন, হাদিস ও ফিকাহর মূলনীতিগুলো অনুসরণ করে ইসলামী অর্থনীতির শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করা, ব্যবসা-বাণিজ্যের নিত্যনতুন পদ্ধতি ও মাধ্যমগুলোর বিকল্প ইসলামী পদ্ধতি বিশ্লেষণ করা ওলামায়ে কেরামের অপরিহার্য দায়িত্ব।
কিন্তু আজ ওলামা সমাজের দুঃখজনক অবহেলার ফলে ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টা সম্পূর্ণ অধরা রয়ে যাচ্ছে। পরিণতিতে সাধারণ মুসলমানরা লিপ্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত হারাম ও অভিশপ্ত সুদি লেনদেনে, যা আল্লাহর আজাবের সম্মুখীন হওয়ার অন্যতম কারণ বইকি?
আলহামদুলিল্লাহ। সর্বস্তরের মুসলমান বিশেষ করে আলেম সমাজের জন্য শোকরিয়ার বিষয় যে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের খ্যাতনামা ফকি্বহ, বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক জাস্টিস আল্লামা মুফতি তাকি উছমানি সাহেব (দা. বা.)-এর পৃষ্ঠপোষকতার যুগের মুফাক্কির, ফকি্বহুল মিল্লাত, আল্লামা, মুফতি আবদুর রহমান সাহেব (দা. বা.) 'মারকাজুল ইক্বতিসাদিল ইসলামী বাংলাদেশ' নামক একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার মাধ্যমে সূচনা করেন এই মহান কাজের, দেশের মানুষকে হালাল উপার্জন ও হারাম থেকে বাঁচানোর সংগ্রাম। যেখানে অতীব যত্নসহকারে 'ফিক্বহুল মুআমালাত' বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, যা শরিয়তের একটা বিরাট অংশ।
অনেককেই না বুঝে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বহু বাজে মন্তব্য ও অবান্তর প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। অথচ বাস্তবতা হলো, এই প্রতিষ্ঠানে কোরআন, হাদিস ও ফিক্বাহর মূলনীতির আলোকে বর্তমান ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত নিত্যনতুন ও আধুনিক পদ্ধতি এবং মাধ্যমগুলো রিসার্চ করে তার বিকল্প ইসলামী সমাধান দেওয়া হয়। অর্থাৎ মানুষ কিভাবে হালাল উপায়ে আয় করবে এবং কিভাবে হালাল পথে ব্যয় করবে, আলেমদের এই শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং জনসাধারণের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া এই প্রতিষ্ঠানের মৌলিক উদ্দেশ্য। কেননা হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, কাল হাশরের ময়দানে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর ব্যতীত কোনো মানব এক পা-ও সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারবে না। তন্মধ্যে দুটি প্রশ্ন হচ্ছে- অর্থনীতি সম্পর্কে অর্থাৎ আয় কোন পথে করেছ এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছ?
তাই সব মুসলমানের চিন্তা করা দরকার যে যেই অর্থনীতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ধরপাকড় করবেন, সেই অর্থনীতি সম্পর্কে বলা হচ্ছে, অর্থনীতি আবার কিসের? অর্থনীতি আর ব্যাংকিং কিভাবে ইসলামী হয়।
আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, মানুষ যা জানে না বা যে ব্যাপারে অজ্ঞ, সে তার দুশমন বা তার বিরোধিতা করে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সহিহ বুঝ দান এবং সহিহ আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
মূল : মাওলানা মীর যাহেদ মিখয়ালভী
ভাষান্তর : সলিমুদ্দীন মাহ্দি
সম্পর্কিত খবর