<p>মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের মনোবিকৃতির কথা বলেছেন এবং এর মধ্যে অন্যতম হলো বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া, যাকে ইংরেজিতে অবসেসিভ কমপালসিভ রিঅ্যাকশন বলে। এটি এমন এক ধরনের প্রতিক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তি কতগুলো চিন্তা বা ক্রিয়া বাধ্যতামূলকভাবে করে।</p> <p>কোনো একটি চিন্তা ব্যক্তিকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে সে কিছুতেই চিন্তা মন থেকে দূরে রাখতে পারে না। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া এক ধরনের রোগ, যার জন্য চিকিৎসারও প্রয়োজন হতে পারে। ব্যক্তি নিজ থেকে বুঝতে পারে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিংবা রোগ মনে নাও করতে পারে। বেশির ভাগ প্রতিক্রিয়াটিকে জটিল মনে না করার কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণে আগ্রহ দেখা যায় না। বিভিন্ন কারণে বাধ্যতামূলক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। যেসব শিশু শৈশবে অনাদর আর অবহেলায় বড় হয়, বেশি বয়সে তারা এমন প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। যেসব পরিবারে শৃঙ্খলা, পরিচ্ছন্নতা, কর্তব্যপরাণয়তা, সময়ানুবর্তিতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শিশুদের গড়ে তোলা হয়, সেই সব পরিবারের শিশুরাও বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া দেখায়। অবদমিত ক্রোধ থেকেও অনেক সময় এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। মনের অন্য এক ধরনের দুর্বলচিত্ত থেকেও বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। অপেক্ষাকৃত বেশি মাত্রার দুর্বলচিত্তের মানুষেরও নিজের ওপর ভরসা অসম্ভব মাত্রায় লোপ পায়। পরিণামে কাজ করায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এবং কারো কারো অন্যের প্রতি প্রচণ্ড মাত্রায় অবিশ্বাস জন্মে। ফলে মনোবিকৃতি তৈরি হয়। শুধু শিশুদের বেলায় নয়, বয়স্করাও বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া ও দুর্বলচিত্তের কবলে পড়তে পারে। তবে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গঠন যেহেতু শৈশবে গঠিত হয়, সে জন্য শৈশবকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।</p> <p>বিষয়টির সঙ্গে মিল আছে বলেই অশ্বিনীকুমার দত্তের একটি বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি। তিনি ছিলেন একধারে সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এবং একজন সমাজসংস্কারক। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে এক বক্তৃতায় তাদের বুঝিয়েছিলেন—‘প্রহার, ভর্ত্সনা এবং শাসন দ্বারা যাহা হইবার নহে, সুমিষ্ট বাক্য, সহানুভূতি এবং ধীরে ধীরে পবিত্রতার দিকে আকর্ষণ দ্বারা তাহা অনায়াসে সংশোধিত হইতে পারে। ’ তিনি যদিও মনোবিজ্ঞানী ছিলেন না, তবু তাঁর বক্তব্য মনোবিকৃতি এবং তা থেকে উত্তরণের পথ নির্দেশ করে। সহানুভূতি ও পবিত্রতার দিকে ধাবিত হওয়া এবং এর মাধ্যমে আমাদের ছেলে-মেয়েদের গঠন করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়ার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বেড়ে ওঠা শিশুদের বেলায় বাধ্যতাধর্মী মনোভাবের প্রভাব লক্ষ করার চিত্র কম নয়। পরিবার, বিদ্যালয় এবং বৃহৎ পরিবার সমাজে এমন চিত্র চোখে পড়ার মতো। সাধারণ সাদামাটা ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারে দেখা যায় প্রহার, ভর্ত্সনা এবং প্রচণ্ড শাসন। এদের মধ্যে আবার অবহেলার পরিমাণও বেশি। এমন বৈশিষ্ট্য আমরা মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও কম লক্ষ করি না। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিদ্যালয়ের ধরন আলাদা হওয়ায় দেখা যায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েরা বিশেষ করে শহরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এরা দারিদ্র্যের কশাঘাতে বড় হওয়ায় পরিবারের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বারাও ভর্ত্সনার শিকার হয়। ফলে এরা অনেক অবহেলার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমাগত এমন অবহেলা বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া করতে শেখায়।</p> <p>সমাজে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানদের চিত্র একটু ভিন্ন। এমন পরিবারগুলোতে শৃঙ্খলা, পরিচ্ছন্নতা, কর্তব্য ও সময়ানুবর্তিতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। পরিবারের আকার আধুনিক সমাজে ছোট হওয়ায় মা-বাবাকে উপরোক্ত বিষয়াবলির প্রতি বেশি জোর দিতে দেখা যায়। পূর্বসচেতন ও অতিসচেতন এমনভাবে অভিভাবকদের মধ্যে পেয়ে বসে এবং উদ্বিগ্নতা এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে, যা সন্তানদের মধ্যে মনের অজান্তেই বাধ্যতাধর্মী মনোভাবের জন্ম দেয়। এমন প্রতিক্রিয়া কম হলে ক্ষতির পরিমাণ কম এবং নিয়মিত পরামর্শদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসা যায় কিন্তু বেশিমাত্রা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে। বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া ক্রমাগত প্রভাব বিস্তার করলে ব্যক্তির মধ্যে দুর্বলচিত্তের ভাব লক্ষ করা যেতে পারে। ব্যক্তির মধ্যে অনেক গুণ ও প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তার প্রকাশ ঘটাতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ফল দাঁড়ায় কম দৃঢ়তা। ফলাফল দারুণ কষ্টের। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অন্যকে অবিশ্বাস করার প্রবণতা তৈরি করে।</p> <p>সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে যাওয়া সামাজিক অপরাধের অন্যতম কারণ বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া বা মনোবিকৃতি। কিশোর কর্তৃক কিশোর হত্যা, অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড, পরিকল্পিত পারিবারিক হত্যাকাণ্ড, অবৈধ ও অনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে হত্যার ঘটনা কোনোটিই বাধ্যতাধর্মী প্রতিক্রিয়া থেকে দূরে নয়। আমাদের বসবাস এমন এক ভোগবাদী সমাজে, যেখানে শিশুরাও শৈশব থেকে পর্যবেক্ষণ করছে তার মা-বাবার ভোগবাদিতাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অতিশাসন ও অতিসচেতনতা। এমন পরিবেশ তার মধ্যে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এ থেকে দূরে থাকার অনেক উপায়ই আমাদের মধ্যে রয়েছে। আমরা সচেতন হলে স্বাভাবিক আচরণের মধ্যে আমাদের সন্তানদের রাখতে পারি। তবে সবার প্রিয় অশ্বিনীকুমার দত্তের পরামর্শ কোনোভাবেই অবহেলা করা যায় না। আমরা যদি তাঁর বাক্যগুলো মা-বাবা, শিক্ষক, প্রতিবেশী ও সমাজপতিদের মধ্যে নিবিষ্ট করতে পারি, তাহলে শিশুদের বেড়ে ওঠার এক সুন্দর পরিবেশ তৈরি হতে বাধ্য। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক পরিপত্র জারি করেছে, যেখানে শ্রেণিকক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীদের নীতিবাক্য বলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করি, এর কোনো না কোনো সুফল আমরা পাব।</p> <p><em>(লেখক- অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট)</em></p>