<p style="text-align: justify;">‘ইয়াদ রাখবা লাহু যাখান দিলিহি, লাহু আরো দেবেই। ই রাইজকের আবদিনকে মুক্ত কাইরকে ছোড়বেই যদি ভাগয়ান চাহে। ইবারকের সংগ্রাম হামনিকের মুক্তিকের সংগ্রাম, ইবারকের সংগ্রাম স্বাধীনতাকের সংগ্রাম।’</p> <p style="text-align: justify;">ওপরের কথাগুলো এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলা ভাষাভাষীর কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য না হলেও অনেকটাই অচেনা ঠেকবে। এর সংগত কারণও আছে। কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের চিরচেনা ভাষণের হলেও ভাষাটি সাধারণের অচেনা। বরেন্দ্র অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ওঁরাওদের একটি অংশের বুলি এটি। ভাষাটির নাম সাদরি।</p> <p style="text-align: justify;">এখন পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে মোট ২৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় বঙ্গবন্ধুর এই অমর ভাষণটি অনূদিত হয়েছে। অন্য কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায়ও ভাষণটি অনূদিত হওয়ার কাজ চলছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ৭ মার্চের ভাষণ পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় প্রকাশ করেছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই)। অন্যদিকে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন উপলক্ষে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা এসআইএল (সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস) ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই ঐতিহাসিক দলিলটিকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ২২টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনুবাদ করে।</p> <p style="text-align: justify;">এর মধ্যে চাকমা, গারো, সাদরি ও ত্রিপুরা (ককবরক) ভাষায় অনুবাদের কাজ করেছে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ উভয়ই। এ ছাড়া মারমা ভাষায়ও ৭ মার্চের ভাষণের লিখিত রূপ প্রকাশ করে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। অন্যদিকে এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বম, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, হাজং, খাসিয়া, খিয়াং, কোচ, কোল, লুসাই, মাহালি, মেইতে মণিপুরি, ম্রো, মুণ্ডা, ওরাওঁ কুড়ুঁক্ষ, পাহাড়ি, পাংখোয়া, সাঁওতাল, তঞ্চঙ্গা ও কোডা জনগোষ্ঠীর ভাষায় অনুবাদ করে ভাষণটি।</p> <p style="text-align: justify;">আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক হাকিম আরিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনূদিত হওয়ার সুবিধা হলো, তারা ভাষণটা নিজের ভাষায় পড়তে পারবে। সেই সঙ্গে তাদের মাতৃভাষারও কিছু উন্নয়ন হবে। নতুন করে কিছু শব্দ ও বাক্যগত প্রকাশ যুক্ত হবে ভাষায়।’</p> <p style="text-align: justify;">এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কর্নেলিউশ টুডু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমরা বঙ্গবন্ধু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে এই কাজটি করেছিলাম। এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেক সদস্যই বাংলা খুব ভালো জানে বা বোঝে না। ভাষণটি যার যার মাতৃভাষায় অনুবাদ করলে তারা পড়তে বা জানতে পারবে।’</p> <p style="text-align: justify;">কর্নেলিউশ টুডু জানান, এখনো যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় ৭ মার্চের ভাষণ অনূদিত হয়নি তাঁরা সেসব ভাষায়ও অনুবাদ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেসব ভাষায়ও এই ভাষণটি পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা তাঁদের।</p> <p style="text-align: justify;">ব্যক্তিগত উদ্যোগেও কেউ কেউ ৭ মার্চের ভাষণটি নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ২০২৩ সালে ভাষণটি ম্রো ভাষায় অনুবাদ করেছেন ওই জনগোষ্ঠীর লেখক ইয়াংঙান ম্রো। ৭ মার্চের ভাষণ অনুবাদের কারণ জানতে চাইলে ইয়াংঙান ম্রো কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ম্রোদের প্রায় ৭০ শতাংশ নিজেদের মাতৃভাষায় পড়তে পারে, কিন্তু বাংলা তেমন জানে না। আমি ভেবেছিলাম, ম্রো বর্ণমালায় এই ভাষণ প্রকাশিত হলে এ জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ তা পড়তে ও জানতে পারবে।’</p> <p style="text-align: justify;"><strong>ঐতিহাসিক ভাষণ অনুবাদের চ্যালেঞ্জ</strong></p> <p style="text-align: justify;">মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি ললিতকলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস চন্দ্র সিংহ এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হয়ে ৭ মার্চের ভাষণ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি জনগোষ্ঠীর ভাষায় অনুবাদ করেছেন। কাজটি কতটা কঠিন ছিল সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অনেক ভাবতে হয়েছে। অনুবাদ করার সময় ভেবেছি বঙ্গবন্ধু আমার ভাষায় যদি ভাষণ দিতেন তাহলে কিভাবে বলতেন।’ এই অনুবাদের তাৎপর্য জানতে চাইলে প্রভাস চন্দ্র সিংহ বলেন, এটা দুটি জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।</p> <p style="text-align: justify;">গারোদের ভাষায় অনুবাদ করা মৃদুল সাংমা ‘ফ্রেন্ডস অব এনডেঞ্জারড এথনিক ল্যাঙ্গুয়েজেস’ (এফইএএল)-এর একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘গারোদের ভাষায় যথাযথ অনুবাদ বড় চ্যালেঞ্জের কাজ ছিল। এ জন্য অনেক ভাবতে হয়েছে।’</p> <p style="text-align: justify;"><strong>অনুবাদ হলেও প্রচার নেই</strong></p> <p style="text-align: justify;">৭ মার্চের ভাষণ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনূদিত হলেও তা তাদের হাতে পৌঁছানোর যথাযথ ব্যবস্থা হয়নি বলে জানান এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গারো জনগোষ্ঠীর মৃদুল সাংমা ও রাজশাহীর মাহালি ভাষায় অনুবাদকারী ফিলিপ হাসদা দুজনেই এ বিষয়ে একমত।</p> <p style="text-align: justify;">বিষয়টি স্বীকার করে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হাকিম আরিফ বলেন, ‘এটা ঠিক যে অনেকেই জানে না। আমাদের বিক্রয়কেন্দ্র থেকে যে কেউ সংগ্রহ করতে পারবে। অথবা কমিউনিটি থেকে কেউ চাইলে আমরাও পাঠাব।’</p> <p style="text-align: justify;">এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি জাতির অহংকার ও অধিকার সচেতনতা জাগ্রত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য সব নৃগোষ্ঠীর ভাষায় এটা অনূদিত হওয়া উচিত এবং তাদের কাছে পৌঁছানো উচিত। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সব ধরনের মুক্তির কথা বলে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর অধিকার আমাদের রাষ্ট্র যদি স্বীকার না করে তাহলে এর (ভাষণের অনুবাদ) কোনো অর্থ থাকবে না।’</p>