<p>আমাদের সমাজে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও যাযাবর জনগোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত। একসময় এদের বসবাস ছিল নৌকায়। নৌকায় চেপে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে গ্রামগঞ্জ বা হাটবাজারে ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। এই জনগোষ্ঠীর মূল পেশা মানুষের শরীরে শিঙ্গা লাগানো, তাবিজ-কবজ বিক্রি, সাপ খেলা দেখানো, সাপের কামড়ের চিকিৎসা, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক (কবিরাজি) স্বাস্থ্য সেবাদান, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, বানরখেলা দেখানো, চুড়ি ফিতা বিক্রি, জাদু দেখানো ইত্যাদি তাদের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন। এখন তারা সড়কপথে বা বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছেন। কেউবা আদি পেশা ছেড়ে চায়ের দোকান, সবজি বিক্রি, রিকশা-ভ্যান চালানো, গাড়িরচালকের কাজ করে থাকেন। এ ছাড়া অনেকে ছেলে-মেয়েদের সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে লেখাপড়াও শেখাচ্ছেন। </p> <p>আর এই বেদে সম্প্রদায়ের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম। তিনি বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে তার অফিসকক্ষে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের দিঘারকুল গ্রামের মৃত দবির মৃধার অনার্সপড়ুয়া ছেলে রোমান মৃধাকে লেখাপড়ার সুবিধার জন্য একটি ল্যাবটপ উপহার দেন। রোমান মৃধা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। </p> <p>রোমানের সঙ্গে কথা হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা তিনি ভাই, তিন বোন। বাবা গোপালগঞ্জ শহরে রিকশা  চালাতেন। রিকশা চালিয়ে আমাদের বড় করেছেন এবং দিঘারকুল গ্রামে সাড়ে চার শতাংশ জমি কিনে ঘর তৈরি করেছিলেন। সেখানে আমাদের বসবাস। বিগত আট বছর আগে বাবা মারা যান। ভাইদের মধ্যে আমি ছোট। বড় দুই সড়কে ফেরি করে ইঁদুরসহ পোকামাকড় মারার ওষুধ বিক্রি করে সংসার চালান এবং বিয়ে করে আলাদা থাকেন। মা অন্যের বাড়ি কাজ করে বোনদের বিয়ে দিয়েছেন আর আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন। আমি দিঘারকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন লেখাপড়া করেছি, তখন প্রতিবেশী ও সহপাঠীরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন। হাইস্কুলে পড়েছি একই ইউনিয়নের শেখ মুজিব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানেও অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছি। কিন্তু শিক্ষকরা আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। এই স্কুল থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৪.১৭ পেয়ে এসএসসি পাস করি। পরে ভর্তি হই গোপালগঞ্জ শহরের হাজী লাল মিয়া সিটি কলেজে। সেখানে মানবিকে জিপিএ ৪.৪৪ পেয়ে এইচএসসি পাস করি। এরপর করার পর অন্যদের বাড়িতে গিয়ে টিউশনি করে লেখাপড়া চালিয়েছি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আর মা দিশেহারা হয়ে পড়ি। তখন টিউশনি বাড়িয়ে দিয়ে সংসারের খরচের পাশাপাশি লেখাপড়া চালাতে থাকি। এখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অনার্স পড়ি ও টিউশনি করি।  </p> <p>তিনি আরো বলেন, মোরাল প্যারেন্টস নামে একটি সংগঠনের মাসে দেওয়া  ১৫০০ টাকায় আমার লেখাপড়া চলছে। বাড়িতে মাকেও খাবার খরচ পাঠাই।  কিন্তু বর্তমান যুগে লেখাপড়ার সুবিধার জন্য কম্পিউটার বা ল্যাবটপ প্রয়োজন। ল্যাবটপ বা কম্পিউটার কিনতে যে অর্থের প্রয়োজন এই সংগতি আমার নেই। এ অবস্থায় আমার মা গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলমের কাছে ছেলের লেখাপড়ার চালিয়ে যাওয়ার সুবিধার্থে একটি ল্যাবটপের আবেদন করেন। মায়ের আবেদনে সারা দিয়ে জেলা প্রশাসক স্যার আমাকে একটি ল্যাবটপ উপহার দিয়েছেন। ল্যাপটপটি পাওয়াতে আমার লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। </p> <p>রোমান মৃধার বৃদ্ধা মা ফুলজান বেগম বলেন, আমরা বেদে সম্প্রদায়। আমাদের কাজ হচ্ছে ফেরি করা। এর মধ্য থেকে আমার ছোটছেলে লেখাপড়ার করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় কষ্ট হলেও তাকে নিষেধ করিনি। আজ আমার ভালো লাগে আমার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমি গোপালগঞ্জের ডিসি স্যারের কাছে একটা ল্যাপটপের আবেদন করি। স্যার আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে ল্যাপটপ দেন। এখন একটা চাকরি হলে ওর ইচ্ছাটা পূরণ হবে। </p> <p>জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম বলেন, আমি চষ্টো করি সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে। এই ছেলেটির মা আমাকে বিষয়টি জানালে আমি রোমান মৃধার লেখারপড়ার সুবিধার্থে একটি ল্যাপটপ উপহার দিয়েছি। আরো যদি এই ধরনের কেউ থাকে আমি তাদের জন্যও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবো।</p>