<p>পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম ও সমাজে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও অবকাঠামো অবয়বে উদ্‌যাপিত উৎসবাদিতে মানবিক মূল্যবোধের সৃজনশীল প্রেরণার, সখ্য-সৌহার্দ্য প্রকাশের অভিষেক ঘটে থাকে। নানা উপায়-উপলক্ষে সম্প্রীতিবোধের বিকাশলাভ ঘটে থাকে, অবনিবনার পরিবর্তে বন্ধন, মতপার্থক্যের অবসানে সমঝোতার পরিবেশ সৃজিত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা, দেওয়ালিসহ নানা পূজা-পার্বণে আত্মশুদ্ধির আনন্দের, অপয়া অসুর সত্তার সংহার, সংবেদনশীলতার শুভ উদ্বোধন ঘটে থাকে। খ্রিস্টীয় বড়দিনের উৎসব সংবৎসরের সব বিভ্রান্তি-বিবাদ-বিসংবাদ ভুলে অনাবিল আনন্দ আচার-অনুষ্ঠানে নিবেদিত হওয়ার সুযোগ সমুপস্থিত করে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সৎ চিন্তা, সৎ ধ্যান ও অহিংস অভেদ বুদ্ধি বিবেচনার বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের পরিপালনীয় নির্বাণ অনুষ্ঠানাদিতে। সব আয়োজন-আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো তার সৃষ্টির সেবা ও সন্তুষ্টি বিধানের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার ইবাদত। সংহার নয়, সেবাই পরম ধর্ম। সব অশান্তি, কলহ-বিবাদে শান্তির সম্ভাবনা শুধু সহযোগিতা-সমঝোতায়ই।</p> <p>সাম্য ও সামাজিক সংহতির ধর্ম ইসলামের ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, আশুরা, শবেবরাত, শবেকদর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব উৎসবের মূল তাৎপর্য হলো আত্মশুদ্ধি ও আত্মোৎসর্গের কঠোর ত্যাগ সাধনার প্রেক্ষাপটে আনন্দঘন সম্মিলন। গরিব-দুঃখীদের মধ্যে দান-খয়রাত করা, ভেদাভেদ ভুলে সবার সঙ্গে এই সম্মিলনে শরিক হওয়া, পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় ও কোলাকুলি, কোরবানি করা পশুর মাংস বিলি-বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিকতার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে থাকে। ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’—এই মহান ব্রত বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবার জন্য সুখময় জীবনযাপন নিশ্চিত হয়। ব্যষ্টি থেকে সমষ্টি। ব্যক্তি কল্যাণের ওপরই রচিত হয় সমষ্টিগত কল্যাণের সৌধ। পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন একে অন্যের প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক সংহতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সামাজিক মূল্যবোধ, যা অভিন্ন সত্তা হিসেবে কাজ করে। এই মূল্যবোধ সহসা কিংবা আরোপিত নির্দেশের বলে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও ব্যাবহারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা স্থিতি আকারে প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ লাভ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে ধর্ম এক বিরাট গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে থাকে। ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েই মানুষের জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে। ধর্মীয় অনুশাসনমালা মানুষের আচার-আচরণ, প্রবৃত্তি-প্রবণতার ওপর একটা গঠনমূলক নিয়ন্ত্রণ নির্দেশ করে। মূলত ধর্মীয় বিধি-বিধান, আচার-অনুষ্ঠান মানুষের আত্মিক উন্নতি লাভের পথ নির্দেশ করে আর এই আত্মগত উন্নতির ওপর ভিত্তি করে সমষ্টিগত তথা সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়ে থাকে।</p> <p>ধর্মীয় উৎসবগুলো সাধারণত বছরের বিশেষ সময়ে ও উপলক্ষে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ আসে—সংবৎসরের জমে থাকা দুঃখ-বেদনা, মনোমালিন্য দূর করার একটা উপলক্ষ তাতে মেলে। ধর্মীয় উৎসবগুলো প্রায়ই কৃচ্ছ্রসাধন, আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের প্রেক্ষাপটে আনন্দের ও ত্যাগের হেতু হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। আত্মকল্যাণ লাভের জন্য কঠোর ত্যাগ, সাধনা ও পরিশ্রমের পর আনন্দের সোপান হিসেবে এই উৎসবের আয়োজন। সে উৎসবে থাকে পরিতৃপ্তির আমেজ। আত্মোৎসর্গের পরিতৃপ্তিতেই অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জাগে। সে জন্য ধর্মীয় উৎসবগুলোতে দান-খয়রাত করা অর্থাৎ বিত্তবান সমর্থরা বিত্তহীন অসমর্থদের সাহায্য করে, আনন্দে সবাই সমভাবে অংশগ্রহণ করে। অন্যের অতৃপ্তিকে নিজের অতৃপ্তি মনে করে সবাই। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আহার্য দ্রব্য, সম্পদসামগ্রী এবং পবিত্র ঈদুল আজহায় জীবজন্তু উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। উৎসর্গিত এসব সম্পদসামগ্রী জীবজন্তুর কোনো কিছুই আল্লাহর দরবারে সরাসরি পৌঁঁছে না। উৎসর্গকারীর পক্ষ থেকে নিবেদিত নিষ্ঠা ও সকৃতজ্ঞতা প্রকাশের ইচ্ছাটিই প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়ে থাকে।</p> <p>‘No one should suppose that meat or blood is acceptable to the One True God. It was a Pagan fancy that Allah could be appeased by blood sacrifice. But Allah does accept the offering of our hearts and as a symbol of such offer, some visible institution is necessary....our symbolic act finds practical expression in benevolence and that is the virtue sought to be taught...we should proclaim the true doctrine, so that virtue and charity may increase among men.’ (আল-কোরআনের ২২ সংখ্যক সুরা আল হজের ৩৭ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইউসুফ আলী)</p> <p>এই ধূলিধরায় উৎসর্গিত সব কিছুই করা হয় সবার মাঝেই। যা কিছু উৎসর্গ করা হয় তা সবই আহার্য কিংবা মানুষের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যা অন্যের ক্ষুধা ও অভাব মিটিয়ে থাকে। সুতরাং দেখা যায়, ধর্মীয় উৎসবের সব কিছুই সামাজিকতার আদর্শ প্রতিফলনের মধ্যেই সার্থকতা লাভ করে থাকে।</p> <p>ঈদুল আজহা উদ্‌যাপনের মধ্যেও নিশ্চিতভাবে রয়েছে আত্মশুদ্ধির সুযোগসহ বিশেষ সামাজিক তাৎপর্য। হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর উদ্দেশে উৎসর্গ করার মহান স্মৃতি স্মরণ করে পালিত হয় ঈদুল আজহা। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানির মাধ্যমে আত্মোৎসর্গের পরিচয় দেওয়া হয়। এই পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে নিজের পাশব প্রবৃত্তি, অসৎ উদ্দেশ্য ও হীনম্মন্যতাকেই কোরবানি করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই বিশেষ ঈদ উৎসবে নিজের চরিত্র ও কুপ্রবৃত্তিকে সংশোধন করার সুযোগ আসে। জীবজন্তু উৎসর্গ করাকে নিছক জীবের জীবন সংহার হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি আত্মশুদ্ধি এবং নিজের পাশব প্রবৃত্তিকে অবদমন প্রয়াস প্রচেষ্টার প্রতীকী প্রকাশ।</p> <p>“আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।</p> <p>ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।”</p> <p>(কাজী নজরুল ইসলাম, কোরবানী, ‘অগ্নিবীণা’)</p> <p>সামাজিক কল্যাণ সাধনে সংশোধিত মানব চরিত্রবলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোরবানির মাংস গরিব আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার যে বিধান, তার মধ্যে নিহিত রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ।</p> <p>হজ পালন ঈদুল আজহার একটি বিশেষ অংশ। পবিত্র হজ অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের মুসলমানরা সমবেত হন এক মহাসম্মিলনে। ভাষা ও বর্ণগত, দেশ ও আর্থিক অবস্থানগত সব ভেদাভেদ ভুলে সবার অভিন্ন মিলনক্ষেত্র কাবা শরিফে একই পোশাকে, একই ভাষায়, একই রীতি-রেওয়াজের মাধ্যমে যে ঐকতান ধ্বনিত হয়, তার চেয়ে বড় কোনো সাম্য-মৈত্রীর সম্মিলন বিশ্বের কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না। হজ পালনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন রং ও গোত্রের মানুষের মধ্যে এক অনির্বচনীয় সখ্য সংস্থাপিত হয়। বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের যা অনুপম আদর্শ বলে বিবেচিত হতে পারে। পশু কোরবানি উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৮৮ লাখ গরু ও খাসি কোরবানি হয়েছিল। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) ধারণা, এবার ৩৫ লাখ গরু এবং ৬০ লাখ খাসি কোরবানি হবে। গরুপ্রতি গড় মূল্য ৩০ হাজার টাকা ধরলে এই ৩৫ লাখ গরু বাবদ লেনদেন হবে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং ৬০ লাখ খাসি (গড়ে আড়াই হাজার টাকা দরে) এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ পশু কোরবানিতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে। কোরবানির পশুর মধ্যে প্রায় ৪৫ লাখ পশু (গরু ২০ লাখ, খাসি-ভেড়া ২৫ লাখ) আমদানি হবে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ভারতীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার রপ্তানি তাদের এবারের প্রত্যাশা। এর একটি বড় অংশ অবশ্য চোরাপথে বা পদ্ধতিতে আদান-প্রদান হবে, যদ্দরুন পশুর সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ অবশ্যই অনুমাননির্ভর। যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন, বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে এ খাতে। ২০ লাখ গরু আমদানির জন্য বাংলাদেশের শুল্ক রাজস্ব (গরুপ্রতি ৫০০ টাকা হিসাবে) ১০০ কোটি টাকা অর্জিত হওয়ার কথা। কোরবানি করা পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমার ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চাঁদা, টোল, বকশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাসিল, পশুর হাট ইজারা, চাদিয়া, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও বানানো, এমনকি পশুর সাজগোজ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে, অর্থাৎ অর্থনীতিতে ফরমাল-ইনফরমাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়।</p> <p><strong>লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান </strong></p>