শুধু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে—শুধু ভিন্নমত পোষণ করলেই—একটি রাষ্ট্র যদি তারই নাগরিকদের ধরে নিয়ে যায়, দিনের পর দিন বন্দি করে রাখে, নির্মম, নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং অবর্ণনীয় নির্যাতনে হত্যা করে, তারপর নিথর দেহটি পর্যন্ত গোপনে গুম করে ফেলে, তাহলে প্রশ্ন উঠে এই বর্বরতা থেকে রাষ্ট্র কী আনন্দ পায়? রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি—এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারে? আয়নাঘরের ইতিহাস আমাদের সামনে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে—যেখানে প্রতিটি গুম, প্রতিটি নিষ্ঠুরতা আর প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানবতা বারবার হেরে গেছে রাষ্ট্রীয় পাশবিকতার কাছে। এই ভয়ংকর ইতিহাস থেকে কি আগামী দিনের সরকার ও তার নিরাপত্তা বাহিনী কোনো শিক্ষা নেবে? নাকি আগের মতোই নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে? তবে আমরা সেই খুনি রাষ্ট্র দিয়ে কী করব?
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ছিল দুঃখ-দুর্দশার বিরুদ্ধে জনতার এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম। এটি ছিল গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ও বৈষম্যহীন সমতার বাংলাদেশ গড়ার ডাক। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, সুশাসন এবং ন্যায্য সমাজ গড়ার প্রত্যাশা।
২০২৪ সালের জুলাই মাসটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উত্তাল ও ঘটনাবহুল অধ্যায়। মানুষের বিশ্বাস জন্মেছিল, ইতিহাস এবার নতুনভাবে লেখা হবে। কিন্তু বছরের শেষ নাগাদ দেখা গেল সেই বিশ্বাস ও বাস্তবতার মাঝে রয়েছে বিস্তৃত ফারাক।
এই গণ-আন্দোলন হঠাৎ গড়ে ওঠেনি।
দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের দুঃশাসন, গুম-খুন, ভোটাধিকার হরণ, বিচারহীনতা, দলীয় দমননীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্য এই আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে। আন্দোলনের পেছনে ছিল বিএনপি, বামপন্থী রাজনৈতিক দল, ইসলামী দল, পেশাজীবী সংগঠন, মানবাধিকার ও নারী সংগঠন, পরিবেশবাদী, প্রবাসী সমাজ, এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদের একাংশ ও আওয়ামী লীগের হতাশ কর্মীদেরও সক্রিয় বা নীরব সমর্থন। এটা ‘সবার আন্দোলন’।
এই আন্দোলনের ফলেই গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তী সরকার।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার নিয়ে জনমনে আশা ছিল যে এটি হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভারসাম্যপূর্ণ ও দায়িত্বশীল। কিন্তু ক্রমেই এ সরকারের মধ্যে ‘নির্বাচিত এলিট’দের নিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা স্পষ্ট হয়। উপদেষ্টা পরিষদে বাদ পড়ে গণ-আন্দোলনের চালিকাশক্তি রাজনৈতিক দল, শ্রমিক, কৃষক, নারী, আদিবাসী ও পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব। আন্দোলনকে ‘মেটিক্যুলাস ডিজাইন’ হিসেবে তুলে ধরে জনতার বাস্তব ভূমিকা অস্বীকার করা হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একক নেতৃত্বে আন্দোলনের কৃতিত্ব নির্দিষ্ট করা হয়, যা গণ-আন্দোলনের বহুমাত্রিকতাকে সংকুচিত ও বিকৃত করে।
৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর নতুন করে শুরু হয় হামলা-মামলা, সন্ত্রাস, খুন, নির্যাতনের ধারা।
গুম হওয়া মানুষ ফেরে না, দুর্নীতি বন্ধ হয় না, অর্থপাচারকারী ধরা পড়ে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। জনগণের মৌলিক সমস্যা থেকে শুরু করে পরিবেশ, নিরাপত্তা, খাদ্য ও চিকিৎসা—সব কিছুতেই ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক সংস্কারের নামে র্যাব-পুলিশ-আনসারের পোশাক পাল্টানো হলেও চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া। কিন্তু আজও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সংস্কার প্রশ্নেও অস্পষ্টতা দেখা দেয়। ‘সংস্কার’কে শুধুই একটি টিক দেওয়ার নীতিপত্রে পরিণত করে ধোঁয়াশাপূর্ণ করে তোলা হয়। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সংশয় ও বিভ্রান্তি বাড়ে।
২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করলেও তাদের প্রস্তাবনা ও রাজনৈতিক ভাষা সাধারণ মানুষের বাস্তবতা ও চেতনার সঙ্গে মেলেনি। ‘বাংলাদেশ’ নামবদলের চিন্তা, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর পরিবর্তে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’—এসব প্রচেষ্টা বিভ্রান্তি তৈরি করে। ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’, ‘রিসেট বাটন’, ‘নতুন সংবিধান’ ইত্যাদি ধারণা সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বাস্তবতাবিবর্জিত বলে অনেকে মনে করেন।
দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা আলাদা করা, উচ্চকক্ষ গঠন, ১৭ বছর বয়সে ভোটাধিকার—এসব প্রস্তাব সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজকে হুমকি, আর নেতাদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারা হয়ে ওঠে শহুরে শ্রেণির কল্পনানির্ভর এক রাজনৈতিক কাঠামো।
অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিচারহীনতা, গুম-খুন অব্যাহত, মাজার ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা রক্ষায় এই সরকারের অবহেলা সমাজে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করেছে। উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ। অভ্যুত্থানের পর ১১ মাস ধরে চলা মব কালচার, দমন-পীড়ন, প্রতিহিংসামূলক হামলা—এগুলো স্পষ্ট করে জনগণের বিজয়ের পরও শাসনযন্ত্রের ব্যর্থতা। স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের বিচার না হওয়ায় জনগণ বেআইনি পথে ঝুঁকছে। মানুষ বুঝতে পারছে, আন্দোলন সফল হলেও ক্ষমতা কাঠামোর বদল না ঘটলে কোনো অর্থ নেই।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, ‘নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই, নির্বাচনই একমাত্র বিকল্প।’ তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে পরিচালিত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহবান জানান। তাঁর মতে, ‘গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি বৈধ, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।’
গণতন্ত্র শুধু একটি শাসনব্যবস্থা নয়; এটি মানুষের অধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার প্রতীক। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো জনগণের মতামত এবং অংশগ্রহণ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে বহুবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পেছনে সাধারণ মানুষের যে ত্যাগ, তা শুধু সুশাসন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করলেই সার্থক হবে।
২০২৪ সালের এই আন্দোলনের চূড়ান্ত অর্জন হতে পারে স্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা ও গণভিত্তিক সরকার। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয় কিংবা আগে নির্বাচন তারপর সংস্কার—এই বিতর্কের বাইরে বাস্তবতা হলো : সংস্কার ও নির্বাচন উভয়ই জরুরি। কারণ জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত না হলে সুশাসন ও গণতন্ত্র টেকসই হয় না। ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করে জনগণই প্রধান শক্তি। তারা ভোট, মতপ্রকাশ ও আন্দোলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বদলায়, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করে।
এ জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় প্রথমেই সংস্কার দরকার, যাতে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য ভোট হয়। সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ছাড়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্ব গড়া সম্ভব নয়। অতএব জনগণের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচিত, জবাবদিহিমূলক সরকার ও সংসদ গড়াই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের যাবতীয় সংস্কার কার্যক্রমের প্রাথমিক ও প্রধান লক্ষ্য। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কার কখনোই কার্যকর ও টেকসই হয় না।
জুলাই আন্দোলন আমাদের শেখায়—গণ-আন্দোলন যদি জনগণের দ্বারা গড়ে ওঠে, তবে তার ফসলও হতে হবে জনগণের হাতে।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে