এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াতকে নতুন বাস্তবতা মাথায় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পর থেকে তাদেরও নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই এগোতে হয়েছে। কখনো সরব আবার কখনো নীরব রাজনীতি করেছে দলটি। দলটিকে উপলব্ধি করতে হবে যে ছদ্মবেশ ধারণ করে জামায়াত নেতাকর্মীদের পক্ষে রাজনীতি করা যতটা সহজ, ততটা ছিল না বিএনপির পক্ষে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার যে অভিযোগ রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে, তারও সুরাহা করতে হবে নতুন বাংলাদেশে। কেবল ২০২৪ সালে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিল, তাদের ব্যাপারে সোচ্চার থাকলে হবে না, ৫৪ বছর আগের ঘটনারও বিচার করতে হবে। অন্যথায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে বিচারের ধরন, আদালত আর ট্রাইব্যুনাল একই থাকবে, বদলে যাবে কেবল বিচারপতিদের নাম।
এসব বাস্তবতা মানার পাশাপাশি কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে। নির্বাচনসংক্রান্ত সবচেয়ে অপ্রিয় প্রশ্ন হলো, বিএনপিকে ছাড়া যদি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কিভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে? শেখ হাসিনার সঙ্গে হয়তো অনেক মন্ত্রী-এমপি, প্রভাবশালী সাঙ্গোপাঙ্গ পালিয়ে গেছেন, কিন্তু দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্য নেতাকর্মীরা কোথায় আছেন? সমর্থন ও জনপ্রিয়তার বিচারে কমবেশি যা-ই হোক, তাঁদের সবাইকে বাইরে রেখে কি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট সম্ভব? অতীতে কি এমন কোনো দৃষ্টান্ত আছে?
যারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তাদের বিচার করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে সর্বোচ্চ শাস্তি। এ বিষয়ে কোনো আপস নয়, বিন্দুমাত্র ছাড় নয়। কিন্তু একজনও যদি নিরপরাধ হয়, তাকে ভোটে যুক্ত করতে হবে, দিতে হবে প্রার্থী বেছে নেওয়ার অধিকার। তবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে, দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হবে গণতন্ত্রের পথচলা। অন্যথায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা থাকবে।
আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতির জটিল সমীকরণে হয়তো অনেক দেশ সমর্থন দেবে, নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কাছে সেই নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে? বিবেচনায় রাখতে হবে সেই প্রসঙ্গ। ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে মোট ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এক হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী। সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী সবাই ছিল মাঠে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই), আফ্রিকান ইলেকটোরাল অ্যালায়েন্সহ আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক আর বিদেশি সাংবাদিকও ছিলেন অনেক। কিন্তু চরম বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের মানুষ বিএনপিকে ছাড়া সেই নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি। এই বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে সবাইকে।
বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে যতটা আগ্রহী, সংস্কার ইস্যুতে ঠিক ততটা না। আবার নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত, এনসিপি। মাথায় রাখতে হবে, অনেক দলের নেতাকর্মীরা যখন প্রচণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে রাজনীতি করেছেন, তখন সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। আবার এও সত্য, যদি গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না হতো, তবে আগের মতো বছরের পর বছর নির্বাচনের দাবিতে রাজপথেই থাকতে হতো বিএনপিকে। এমন পরিস্থিতি অনুধাবনের পরও কেন ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে এত বিরোধ থাকবে? সর্বশেষ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনসহ মৌলিক কিছু ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়েছে। সেখানে আগেও কয়েকবার হট্টগোল হয়েছে, পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগে আলোচনা বর্জন করছে কোনো কোনো দল।
লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেওয়ায় সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে জামায়াত, যে কারণে প্রথম দিন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকেও যোগ দেয়নি দলটি। আবার কয়েক দিন আগে বিএনপিও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পাশাপাশি সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতা যাচাই করতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারে ভোট করার দাবি করছে এনসিপি। যদি সরকার, উপদেষ্টা কিংবা ইসির মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করা হয়, তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হবে। তার চেয়ে সবাই কিছুটা উদার মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় বসুন, কারণ এখন ঐক্য প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপিকে বুঝতে হবে, তারা রাষ্ট্রক্ষমতার সম্ভাবনাময় দল। ফলে তার ওপর ঝড়ঝাপটা একটু বেশি আসবে, ষড়যন্ত্রও হবে বেশি। গুজব-গুঞ্জন আর নানা রকমের আলোচনা-সমালোচনা হবে। সেসবে বেশি প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ধৈর্য ধরে ঐক্যপ্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। অন্যদেরও আমলে নিতে হবে জনসমর্থন আর সাংগঠনিক অবস্থা। মাথায় রাখতে হবে, সারা দেশে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট দেওয়ার মতো নিবেদিত কর্মী আছে কি না? এসব বাস্তবতা উপেক্ষা করে নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়ানো কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।
কারণ ৫ আগস্টের পর বিএনপি আর জামায়াতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঐক্য থাকার কথা ছিল। কারণ দীর্ঘদিনের মিত্র তারা। এমনকি এনসিপির সঙ্গেও বিএনপি, জামায়াতের কোনো বিবাদের কারণ নেই। কারণ সব দলেরই দাবি, ক্ষমতার বদলে জনতার কল্যাণ চায় তারা। এ ছাড়া সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসেই শেখ হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত হয়েছে। যে স্বপ্ন নিয়ে তখন সবার ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, আবারও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সেই ইস্পাতকঠিন ঐক্য দেখতে চায় সাধারণ মানুষ।
তার পরও রাজনীতিতে বহু মত, বহু পথ থাকবে। থাকবে দ্বিমত পোষণ করার গণতান্ত্রিক অধিকার। এর মধ্যেই খেয়াল রাখতে হবে, যেন নষ্ট না হয় আন্দোলনের সুফল। সে জন্য একক ক্রেডিট নেওয়ার প্রবণতা পরিহার করে জুলাই বিপ্লবকে সর্বজনীন করে তুলতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো সোচ্চার, দেশে-বিদেশে করছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। তাদের হুংকার, গর্জনকে খুব হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই, সুযোগও নেই খুব একটা। কারণ নিমেষেই পাল্টে যেতে পারে রাজনীতির গুটি। তাই সবাই মিলে দ্রুত জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক
হেড অব নিউজ, নিউজ২৪