সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের নিরিখে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে মূলত দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। চালু হয়েছিল একদলীয় বাকশাল সরকার ব্যবস্থা। চারটি ছাড়া বাকি সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল। এই সংশোধনী কার্যত দেশকে স্বৈরপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এরপর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মানুষের ভোটাধিকারের ওপর কুঠারাঘাত করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত হয়—এই অজুহাতে ওই সংশোধনী আনা হয়। এরপর দেশে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিজম বিকশিত হয়। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হয়।
সংস্কারের ভালো ও মন্দ দুটি দিকই আছে। দেশ ও মানুষের স্বার্থে যে সংস্কার সেটি ভালো। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে সত্যিকার এক সংস্কারের স্বপ্নে। তাদের একটিই চাওয়া—পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো আর যাতে কেউ দেশে গুম, খুন, লুটপাট, অন্যায়-অবিচার ও দুঃশাসনের রামরাজত্ব কায়েম করতে না পারে। এ লক্ষ্যে তারা সংস্কারের রূপরেখাও দিচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে এরই মধ্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ৫৫টি ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ১৯ দফা প্রস্তাব পেশ করেছে। রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিবর্গও নানাভাবে সংস্কারের কথা বলছেন, সুপারিশ করছেন। রাষ্ট্রের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে প্রশাসনিক, আইন, বিচার, নির্বাচন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অগ্রাধিকার পাচ্ছে। জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রণয়ন, এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন, জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গঠন, দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, স্বাধীন বিচার বিভাগ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সংরক্ষণ এখন সংস্কার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
গণ-অভ্যুত্থানের পর সংস্কার ইস্যুতে তৈরি জনমত বাস্তব রূপ দিতে এরই মধ্যে সরকার সংবিধান, নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ ও বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ক ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। এরই মধ্যে কমিশনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রমও শুরু করেছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার ও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনেরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কমিশনগুলোকে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে। এমনকি সংস্কার কমিশনগুলোও বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করছে।
শেষ পর্যন্ত সংস্কারের গতিপথ কী হবে কিংবা সত্যিকারের সংস্কার কতটুকু হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে প্রকৃত সংস্কারে সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। সরকারের সদিচ্ছা ও নাগরিক সমাজের স্বপ্নের মিশেলে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে যাক, আপাতত এটিই প্রত্যাশা।
দুই.
তীব্র জনরোষে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে নতুন ধরনের এক পাবলিক সেন্টিমেন্ট (জন মনোভাব) গড়ে উঠেছে। বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এ ধরনের চিন্তার প্রকাশ ঘটে। আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যেও এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। আরব বসন্তের সঙ্গে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের অনেক মিল আছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের মোড়কে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এই গণবিপ্লব হয়েছে। এ জন্য অনেকে একে বাংলা বসন্ত বলছে। এখন আবার সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। তবে আজকে যে সংস্কারের পরিবেশ তৈরি হয়েছে তার পেছনে বিএনপির অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
অর্ধদশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের দাবিতে বিএনপি সোচ্চার রয়েছে। লাখ লাখ মামলা, হামলা, নির্যাতন, গুম ও হত্যাকাণ্ড বিএনপির নেতৃত্বকে সংস্কারের দাবি থেকে টলাতে পারেনি। বরং বারবারই নেতারা সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ২০১৭ সালে ভিশন-২০৩০, ২০২২ সালে ২৭ দফা এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৩১ দফা ঘোষণা করে দলটি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আজকে মোটাদাগে যেসব সংস্কারের দাবি তোলা হচ্ছে তার প্রায় সবই বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে রয়েছে।
প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলছে বিএনপি। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রণয়ন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বিএনপির প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া রুখতে একই ব্যক্তি পর পর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করার বিষয়টি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হচ্ছে।
সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, বিএনপির কার্যত শীর্ষ নেতা ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সত্যিকার সংস্কারে গুড জেসচার (সদিচ্ছা)। কারণ সাধারণত দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষাই মূলত রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর নজির রয়েছে। যেমন—যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলোই কিন্তু বিজয়ী নেতারা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। এমনকি দলগুলোর প্রতিশ্রুতিও ওই দেশের ভোটে প্রভাব রাখে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় তারেক রহমানের ভূমিকারও কিন্তু একটা গুণগত দিক রয়েছে। তিনি তার দল প্রণীত ৩১ দফা প্রচারের পাশাপাশি বাংলাদেশে শান্তি, সৌহার্দ্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তা বাস্তবায়নে তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছেন। সাম্প্রতিক বক্তব্য ও পদক্ষেপ স্পষ্টতই তার নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত করেছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পূর্বাপর তার দৃঢ় রাজনৈতিক পদক্ষেপ বাংলাদেশকে স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে নিয়েছে।
তারেক রহমানের ভাষায়, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই, সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমাদের আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচারী হয়ে যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন।’ তিনি একই সঙ্গে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সুপ্রিম কোর্টের জন্য আলাদা সচিবালয়, ন্যায়পাল নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের কথা পুর্নব্যক্ত করেন। তার এই বক্তব্য সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
তারেক রহমানের ন্যারেটিভ এমন—শুধু ক্ষমতায় যাওয়া নয়, মানুষের কল্যাণ সাধন রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ঈপ্সিত লক্ষ্য। এভাবে তার মধ্যে বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লিগ্যাসি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা বুঝে রাজনীতি তাকে বাবার মতো তুমুল জনপ্রিয় হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। তিনিও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে এখন পর্যন্ত পথ হারাননি। সামনের দিনগুলোতেও তারেক রহমান ও তার দল বিএনপি পথ হারাবে না, এটিই এখন বাংলাদেশের নতুন স্বপ্ন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক