<p>বিগত এক দশকে শিক্ষায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে—এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। সরকারি তথ্য অনুসারে দেশে প্রতিবছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে সাক্ষরতার হার। তবে তা বাড়ছে খুবই ধীরগতিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর এই হার প্রায় ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৫.৬ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭৪.৭ শতাংশ। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও দেশের ২৪.৪ শতাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। দেশে যত দিন একজনও নিরক্ষর থাকবে, তত দিন পর্যন্ত সরকার সাক্ষরতা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে—এমনটি আমার প্রত্যাশা। দেশে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের বিষয়টিকে কোনোক্রমেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধন করেছে এবং ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে তা সামগ্রিক অর্থেই ইতিবাচক। শিক্ষায় এত উন্নয়নের পরও প্রতিটি উপজেলায় একটিও মানসম্মত স্কুল-কলেজ নেই কেন—এটাই আমার প্রশ্ন। কারণ ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকদের যেতে হচ্ছে রাজধানীতে অথবা জেলা শহরে। এর পরও জেলা পর্যায়ে ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত আসন নেই। এতে হয়রানিতে পড়তে হয় অভিভাবকদের। এই হয়রানি কবে বন্ধ হবে কেউ জানে না।</p> <p>সম্প্রতি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। যে পরিমাণ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে, সেই পরিমাণ আসন ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। অর্থাৎ জিপিএ ৫ পেয়েও ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাবে না অনেক শিক্ষার্থী। ২০২১ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪৬ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন।</p> <p>গণমাধ্যম সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে মানসম্পন্ন কলেজের সংখ্যা পৌনে দুই শ। এসব কলেজে আসন রয়েছে ৮০ থেকে ৯০ হাজার। এই কলেজগুলোতেই শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে চায়। অন্যদিকে পুরো দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নজর থাকে রাজধানীর কলেজগুলোর দিকে। রাজধানীতে মানসম্পন্ন কলেজের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫টি। এসব কলেজে যে শিক্ষার্থীদের স্কুল সংযুক্ত, তাদের আগে ভর্তির পর কর্তৃপক্ষ বাকি আসনে বাইরের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করবে। ফলে রাজধানীর ভালো কলেজগুলোতে ২০ থেকে ২৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবে না। তাহলে জিপিএ ৫ পাওয়া বাকি শিক্ষার্থীরা কোথায় ভর্তি হবে? ভর্তি হতে হবে কম মানসম্পন্ন কলেজে। অর্থাৎ একই ফল করেও একই মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে এসব শিক্ষার্থী, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে; কিন্তু মানের বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়নি। তাই সবাই ঢাকায় ভালো মানের কলেজে ভর্তির জন্য এক ধরনের মানসিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ নিরসন করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি ভালো মানের স্কুল এবং একটি কলেজ থাকা বাঞ্ছনীয়। কেন প্রতিটি উপজেলায় মানসম্মত স্কুল-কলেজ নেই, এর জন্য কেন কোনো গবেষণা নেই, কী কারণে ভালো মানের স্কুল-কলেজ গড়ে ওঠেনি। সরকার তো ঠিকই বাজেট দিচ্ছে। আগের তুলনায় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। অনেক উপজেলায় অনেক স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। এর পরও কেন আমরা মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিটি উপজেলায় গড়ে তুলতে পারিনি। এটাই এখন বড় প্রশ্ন। এ জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা ও তদারকি প্রয়োজন। কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। পরে এরই ধারাবাহিকতায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। </p> <p>মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হলে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষকতা পেশায় আসে সে বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। এখন সবাই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে অন্য পেশায় চাকরি করতে চায়। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলেই হবে না, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ জনবল জরুরি। অর্থাৎ শিক্ষক নিয়োগে কোনো কম্প্রোমাইজ চলবে না। শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। জেলা পর্যায়ে একজন শিক্ষক যে সুযোগ-সুবিধা পান, সেই সুযোগ-সুবিধা উপজেলা পর্যায়ে নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সরকার কর্তৃক একটি জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে এবং শিগগিরই একটি সেল নির্ধারণ করতে হবে, যাদের কাজ হবে প্রতিটি উপজেলায় মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ত্বরিত পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। জিপিএ ৫ পেয়ে কেউ ভালো কলেজে পড়াশোনা করবে, আবার কেউ ভালো কলেজে পড়ার সুযোগ পাবে না—এটা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো বৈষম্য থাকবে না, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা যদি মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে চাই তাহলে স্কুল ও কলেজের গুণমানকে সংজ্ঞায়িত করা, মূল্যায়ন করা এবং পর্যবেক্ষণ করা একান্ত দরকার। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের অবস্থা সঠিকভাবে নিরীক্ষণ করার জন্য আরো কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার, যেমন শিক্ষকদের শিক্ষাবিদ্যা, নেতৃত্ব, লক্ষ্য, পেশাদারির সূচক ইত্যাদি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়নের জন্য সরকারকে কিছু কৌশল নিতে হবে। শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের মূল্যায়নের আওতায় আনতে হবে। সেই অনুযায়ী তাঁদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক থাকা দরকার, যাতে প্রত্যেক শিক্ষক একটি ক্লাস নেওয়ার পর কমপক্ষে ৩০ মিনিট বিরতি পান। তাহলে শিক্ষার মান উন্নয়ন করা সম্ভব। কারণ উপজেলা পর্যায়ে বা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিরতিহীন ক্লাস নিতে হয়। এ জন্য অনেক সময় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায় না। বাস্তবিক অর্থে সরকারকে শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে এবং তাঁদের সুপারিশের আলোকে প্রতিটি উপজেলায় একটি মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানে একটি স্কুল এবং একটি কলেজ যেন গড়ে উঠে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।</p> <p>লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ত্রিশাল, ময়মনসিংহ</p> <p> </p>