আমি বাস্তবসম্মত যুক্তিসংগত মতের কথা বলছি।
বাংলাদেশে এখন সভ্যতা নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই। ‘সংস্কৃতি’ কথাটা ‘অপসংস্কৃতি’ অর্থে খুব চালু আছে। সরকার সংস্কৃতি দিয়ে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের মোকাবেলা করার ঘোষণা দিয়েছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’, ‘প্রশ্ন ফাঁসের সংস্কৃতি’, ‘জুলুম-জবরদস্তির সংস্কৃতি’, ‘মিথ্যাচারের সংস্কৃতি’, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’, ‘ঘুষ-দুর্নীতির সংস্কৃতি’, ‘নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি’ ইত্যাদি কথার ব্যাপক ব্যবহার। এগুলো লক্ষ্য করে বলা যায়, বাংলাদেশে অপসংস্কৃতিকেই এখন সংস্কৃতি বলা হয়। বর্বরতাকেই কি এখন সভ্যতা বলা হবে? যুদ্ধবিগ্রহ, অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি কি সভ্যতার পরিচায়ক?
যে গুণে মানুষ মানুষ হয়ে উঠেছে তা হলো তার সংস্কৃতি। বিবর্তন সংস্কৃতির কারণেই ঘটেছে। বিবর্তন সভ্যতার কারণেই ঘটেছে—এ কথাও বলা যায়। মানুষের সংস্কৃতি আছে, সভ্যতা আছে। মানুষেরই বিবর্তন আছে। অন্য কোনো প্রাণীর সংস্কৃতি নেই, সভ্যতা নেই—বিবর্তনও নেই। ৫০ হাজার বছর আগে গরু, মহিষ, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, বাঘ, সিংহ যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে; কিন্তু এই সময়ের মধ্যে মানুষ ভেতরে-বাইরে বদলেছে, মানুষ তার সামাজিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশও পরিবর্তন করেছে—নিজের জীবনযাত্রার অনুকূল করেছে। মানুষ এত কিছু করেছে যে সংক্ষেপে তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সংস্কৃতি, সভ্যতা, প্রগতি আদর্শ—এসব মানুষের জৈবিক সামর্থ্যের ফল। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীরই এ রকম সামর্থ্য নেই। তাদের সভ্যতা নেই, সংস্কৃতি নেই, প্রগতি নেই, আদর্শ নেই।
মানুষের সভ্যতার পরিচয় তার এমন সব কাজের মধ্য দিয়েই, যেগুলো অন্য কোনো প্রাণীরই নেই। যেমন— আগুনের ব্যবহার, পানির ব্যবহার। মানুষ জলবায়ু ও প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগায়। মানুষ পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাষ্ট্র গঠন করে। মানুষ বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। প্রত্যেক রাষ্ট্রে আছে প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি। মানুষের আছে প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য। মানুষের আছে রাজনীতি ও অর্থনীতি। এসবেরই মর্মে আছে নৈতিক চেতনা—ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত ও ন্যায়-অন্যায়ের বোধ। মানুষের আছে বিবেক। বিবেক আর সত্য, ন্যায় ও সুন্দর হলো সভ্যতার মর্মগত অবলম্বন। যেসব মানবীয় কাজের ও সৃষ্টির কথা এখানে উল্লেখ করলাম এসবই সভ্যতার অবলম্বন—এসবের মধ্য দিয়েই মানুষের সভ্যতার পরিচয়।
যখন বিবেক দুর্বল হতে থাকে যখন নৈতিক চেতনা-ন্যায়-অন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ, ভালো-মন্দবোধ দুর্বল হতে থাকে, সম্মিলিত জীবনের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষ মনোযোগ হারাতে থাকে, মানুষ ব্যক্তিতান্ত্রিক—individulistic, egocentric, egoistic হয়ে পড়ে, তখনই সভ্যতার সংকট দেখা দেয়। মানবীর সব কিছুতেই তখন দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। অবস্থা এমন হয় যাকে বলা হয় সভ্যতার সংকট।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই যুদ্ধবিগ্রহ বেড়ে গেছে এবং গণহত্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বব্যবস্থা কল্যাণকররূপে থাকেনি। আগুন-পানির ব্যবহার, প্রকৃতির ব্যবহার, বৃহৎ শক্তিগুলো এমনভাবে করে চলছে যে প্রকৃতি মানুষের প্রতিকূল হয়ে পড়েছে। উষ্ণতা বাড়ছে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা এমনভাবে বেড়ে চলছে যে অবস্থার উন্নতির ব্যবস্থা না করা হলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর স্থলভাগের এক-তৃতীংয়াশ পানির নিচে চলে যাবে। পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, রাষ্ট্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কায়েমি স্বার্থে প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থাকে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও শিল্প-সাহিত্যের অপব্যবহার বর্বরতার সহায়ক হচ্ছে। দুই বিশ্বযুদ্ধের কালে প্রশ্ন উঠেছিল—‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপও’, ‘মানুষের কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে?’ রাজনীতি-অর্থনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে কায়েমি স্বার্থে। সাধারণ মানুষ ঘুমন্ত। সাধারণ মানুষ সব রকম অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি ও মিথ্যাচারকে মেনে নিয়ে চলছে। সমাজ, সংগঠনে, প্রতিষ্ঠানে ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় যারা কর্তৃত্ব করছে তাদের বলা যায় অন্ধকারের শক্তি। এসবই সভ্যতার সংকটের পরিচায়ক।
মানবজাতির জীবনে এ এক অন্ধকার যুগ। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির জীবনে অন্ধকার যুগের অবস্থা বিভিন্ন রকম। বিভিন্ন জাতির ইতিহাস বিভিন্ন; খুব স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান অবস্থাও এক রকম নয়। সংকটের সমাধানের উপায়ও বিভিন্ন রকম হবে। তবে কিছু বিষয়ে সব জাতির মধ্যে মিলও আছে। সংকটের সমাধানের চেষ্টায় সর্বজাতিক ঐক্যের দরকার আছে। তবে সর্বজাতিক ঐক্যের জন্য কোনো জাতিরই নিজের সংকটের সমাধান স্থগিত রাখা কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকা উচিত নয়। নিজের সমস্যা নিয়ে প্রত্যেক জাতিকে সমাধানের ও উন্নতির প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তাতে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী শক্তিগুলোকে দেখা যাচ্ছে বিশ্ব সরকারের ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘ কী করছে জি-সেভেনের হয়ে। চীন ও রাশিয়া কখনো কখনো ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করে কোনো কোনো অন্যায় হতে দিচ্ছে না। তবে তারা সাধারণভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পতাকা নিয়ে—বিশ্ববাসীর সমর্থন নিয়ে চলছে না।
বাংলাদেশ তার নিজের কারণে এবং বৈশ্বিক কারণে সভ্যতার চরম সংকটে বিপতিত। বাংলাদেশের রাজনীতির ও রাজনৈতিক দলের গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল তা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে এখনো চালানো হচ্ছে নিঃরাজনীতিকরণের ও নিঃরাষ্ট্রকরণের কার্যক্রম। গত প্রায় ৪৮ বছর এখানে রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়নি। এখনো রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেই। উচ্চ ও উচ্চ মধ্য শ্রেণির লোকেরা তাঁদের সন্তানদের বিদেশে নাগরিক করে চলছেন। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল দেশের রাজনীতিকে করে ফেলেছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অভিমুখী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক অভিমুখী। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রগঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বিচারব্যবস্থা দুর্গত। প্রশাসনব্যবস্থা গণবিরোধী ও ঘুষ-দুর্নীতিতে সম্পূর্ণ বিকারপ্রাপ্ত। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ইত্যাদি কথা সংবিধানে লেখা আছে, বাস্তবে কোনোটাই অবলম্বন করা হচ্ছে না। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে ক্রমাগত বলা হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক নির্দলীয় সরকার গেছে, জরুরি অবস্থা গেছে। অবস্থার অবনতি থেকে আরো অবনতি চলছে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সব প্রতিষ্ঠান ভেতর থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। যেকোনো ধরনের আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার উপযোগী কোনো রাজনৈতিক দল দেশে নেই। পরিবারব্যবস্থা দারুণভাবে বিপর্যস্ত। বিবাহবিচ্ছেদ, পরকীয়-পরকীয়া, স্বামী-স্ত্রীতে সন্দেহ ও অবিশ্বাস, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা ক্রমবর্ধমান। ভগ্ন পরিবারের সন্তানদের চরম দুর্গতি বেড়ে গেছে এবং বেড়ে চলছে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক অনেক শিথিল হয়েছে এবং আরো শিথিল হচ্ছে। ধর্ষণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকারের জন্য আলাদা আলাদাভাবে নিতান্ত গতানুগতিক চিন্তা ও মত প্রকাশ করা হচ্ছে। শুধু বিচার ও শাস্তি দ্বারা, আইন-কানুনের কঠোরতা দ্বারা সমস্যার সমাধানের কথা বলা হচ্ছে। এতে যেমন চলছিল, তেমনি চলছে, অবস্থার একটুও উন্নতি হচ্ছে না। রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠনের বৃহত্তর কর্মসূচি ও কার্যক্রম দরকার।
যে সভ্যতার সংকট ও সামাজিক অবক্ষয় বাংলাদেশে চলছে তার প্রতিকারের জন্য নতুন চিন্তা, নতুন নেতৃত্ব ও নতুন কাজের ধারা দরকার। সে বিষয়ে অন্য কোনো দিন আলোচনা করব।
লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সাবেক অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা