<p>বুদ্ধদেব গুহ কোনো একটা উপন্যাসে লিখেছিলেন, আমাদের সমাজ হলো একটা দ্বীপপুঞ্জের মতো, যাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটা অভিন্ন সত্তা। আর যত কাছে যাওয়া যায় ততই বোঝা যায় যে সমাজ ধর্ম, শ্রেণি, গোত্র, রাজনীতি এবং আরো অনেকভাবেই বিভক্ত। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাভাবিকভাবেই আসে পরিবার, যেখানে সব সদস্য একটা সত্তার (entity) অংশ হওয়া সত্ত্বেও দিনশেষে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেকের রয়েছে একান্ত নিজস্ব একটা জগৎ, যা একজনের থেকে অন্যেরটা আলাদা।</p> <p>যেখানেই কর্তৃত্ব করার সুযোগ রয়েছে সেখানেই মানুষের বোধ হয় একটা সাধারণ প্রবণতা থাকে নিজের দর্শন, উপলব্ধি বা চাওয়া অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার। কখনো বুঝে, কখনো না বুঝে আবার কখনো নিজের অহং ও মানসিক হীনম্মন্যতা থেকে। এটা মা-বাবা তাঁদের ছেলেমেয়ের ওপর, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের ওপর, শাশুড়ি ছেলের বউয়ের ওপর আবার কখনো ছেলের বউ শাশুড়ির ওপর...এবং এই তালিকা লিখে শেষ করা যাবে না।</p> <p>এই চাপিয়ে দেওয়ার বা ব্যক্তিস্বাধীনতায় খুব বেশি অযাচিত হস্তক্ষেপ করার এই প্রবণতাটা মূলত দুই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে।</p> <p>প্রথমত, নিজের অস্তিত্ব, মতামত আর চিন্তার অধিকারের ওপর অন্যের খবরদারির এই বিষয়টি মেনে নিতে না পারার দরুন সেই ব্যক্তি একটি দম বন্ধ অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করতে থাকেন, আর এই যন্ত্রণা অবদমিত হতে হতে তার মধ্যে একটা সুউডো-ডিপ্রেশনের জন্ম দেয়। দিনের পর দিন এর মধ্যে থাকতে থাকতে মনস্তাত্ত্বিক স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যায়। সিভিয়ার ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে। আমাদের সমাজে মহিলারা বোধ হয় সবচেয়ে বেশি এ অবস্থার শিকার হন। একজন অসুখী, ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিক্ষুব্ধ একজন মানুষ পরিবারের সার্বিক পরিবেশের প্রতি কিংবা নিজের প্রতি সুবিচার করবে, তা বোধ হয় আশা করা অন্যায় হবে। যদিও তাদের এই পরিস্থিতির জন্য তারা খুব বেশি দায়ী নয়। আর প্রকারান্তরে তারাও পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সত্যিকারের সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে নিজের একটা বঞ্চনার জগৎ তৈরি করে নেয়। আর তাদের চারপাশের মানুষ যখন এটা বুঝে যায়, তখন অনেকেই এটার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে।</p> <p>দ্বিতীয়ত, জীবনের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন একান্ত জগতে আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা। এ সমস্যা আপাতদৃষ্টিতে খুব জটিল মনে না হলেও বাস্তবে এটা একটা ভয়ানক সমস্যা। এ ক্ষেত্রে স্পেস না দেওয়া বা না পাওয়া সন্তান, ভাইবোন, ছেলে বা মেয়েবন্ধু কিংবা স্বামী-স্ত্রীরা পরিস্থিতির কাছে হার মানেন না। বরং যেকোনোভাবে সবার অজান্তে নিজের স্বাধীনতার একটা আলাদা জগৎ তৈরি করে নেন। বাস্তবতা আর জীবনের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এই একান্ত জগৎ মানুষকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক অজানা-বিপদসংকুল-অর্থহীন এবং আত্মঘাতী পথে ঠেলে দিতে পারে। যেখান থেকে বের হওয়াটা সহজ নাও হতে পারে। ইন্টারনেট বা সেলফোন, চ্যাটিং বা ভিডিও গেমস আসক্তি, সুপারহিরো কার্টুন-কমিক, উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ-সশস্ত্র রাজনীতি কিংবা অপরাধপ্রবণতা, পর্নোগ্রাফি, ড্রাগস, অনিয়ন্ত্রিত সেক্সের মতো অনেক কিছুই হতে পারে তার এই জগতের মূল আনন্দের জায়গা। আর দুষ্টচক্র সহজেই এ ধরনের মানুষদের ম্যানিপুলেট করতে পারে। যেমনটি আমরা গুলশানে হোলি আর্টিজানের ক্ষেত্রে দেখেছি। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সাহস করে বলতে চাই যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পড়াশোনায় ভালো—অসাধারণ রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েরাও এই বিচ্ছিন্নতায় ভোগে। কারণ সে শুধু বই থেকেই শিখেছে আর পরীক্ষায় ভালো ফল করার কারণে তার অভিভাবকরা সব সময়ই সন্তানের ওপর যারপরনাই খুশি ছিলেন। একটা সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার অন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলির বিষয়টি তাঁরা দিব্যি না দেখার ভান করেন। কারণ ওটা তাঁদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। এটার পেছনেও রয়েছে সেই চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা।</p> <p>ঢাকায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মূলধারার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে না। আর শ্রেণিসচেতন উচ্চবিত্ত সহপাঠীরাও তাদের সহজ করে নেয় না। সুতরাং তারাও একধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগে অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়।</p> <p>আত্মকেন্দ্রিকতার আরো একটি খারাপ দিক হলো—এটা একটা ভীষণ ছোঁয়াচে অসুখ। মানুষের আত্মবিশ্বাসের আর নিজের মৌলিক বিচারবোধের অভাবে অন্য মানুষ খুব সহজে আক্রান্ত হন। কোনো কোনো পরিবারে তো স্বার্থপরতাকে রীতিমতো উৎসাহিত করা হয়।</p> <p>আমার পরিচিত এক চিকিৎসক দম্পতি আছে। ভদ্রমহিলা নানা কারণে খুব ঘন ঘন ডিপ্রেশনে ভোগেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তাঁর স্বামী একজন ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও এটাকে কোনো অসুখ বলে মানতে নারাজ। আর সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা তো সহ্যই করতে পারেন না। এই যদি হয় একটি চিকিৎসক পরিবারের চিত্র, তাহলে অন্য পরিবারে কী অবস্থা তা তো বলাই বাহুল্য।</p> <p>আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার পেছনে বোধ করি আমাদের শহরগুলোর চরিত্রেরও অনেকটাই প্রভাব থেকে যায়। আর আমাদের রাজধানী মেগাসিটি ঢাকা তো রীতিমতো আত্মকেন্দ্রিক-বিচ্ছিন্ন মানুষ তৈরি করার এক মেগা-কারখানা। প্রথম যখন ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করলাম, তার কয়েক বছরের মধ্যেই উপলব্ধি করেছিলাম যে এই শহরটাকে সবাই শুধু নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহারই করে গেল, কেউ ভালোবাসল না। পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে জানি না! মধ্যরাতে হাই ভলিউমে টেলিভিশন দেখি, আমার চারপাশের মানুষগুলোর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই কারো। লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি রওনা হওয়ার পর জানতে পারি, অমুক ফ্ল্যাটের তমুক সাহেব আজ সকালে মারা গেছেন কিংবা তিনি যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন একটা ফোন করেও খোঁজ নিইনি যে তিনি কেমন আছেন! গরমে একজন মধ্যবয়সী মহিলা অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলেও প্রায় কেউই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসি না । কিন্তু স্মার্টফোনে সেই বেচারির ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিতে ভুলি না। চারদিকে এই প্রবণতা আর চর্চা কখনো কখনো আত্মকেন্দ্রিক হতে উৎসাহিতও করতে পারে।</p> <p>বাচ্চাদের খেলার মাঠ দখল করে আমরা অট্টালিকা বানাচ্ছি আর বৈষয়িক তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি। অর্থবিত্ত, ক্যারিয়ার, সোশ্যাল স্টেটাস, ফ্ল্যাট, প্লট, সোনার গয়না আর ফ্যাশনের পেছনে অন্ধের মতো ছুটছি; আর আমাদের সময় হয় না অন্যের প্রতি সমবেদনা-সহমর্মিতা প্রকাশ করার, বিপদের সময় সামনে এগিয়ে আসার। এর সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো, সন্তানদের মা-বাবার অমূল্য সঙ্গ আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ থেকে বঞ্চিত করা। গত ১ জুলাই গুলশানে হোলি আর্টিজানের ভয়াবহ হামলার ঘটনার আক্রমণকারী এবং পরে নিহত সেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবকদের কারো মা-বাবাও কি কখনো এ রকম কিছু করেছিলেন। সৃষ্টিকর্তা ওনাদের এই কষ্ট সহ্য করার শক্তি দিক।</p> <p>Into the Wild—সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি করা এই ফিল্মে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি নিজের ইচ্ছাতেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বহুদিনের জন্য স্বেচ্ছানির্বাসনে বনজঙ্গলে ছিল। সেখানেই মারা যাওয়ার আগে তার শেষ অনুধাবনটি ছিল ‘Happiness is real when it is shared’।</p> <p>এখন বোধ হয় সময় এসেছে সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি করার, কমপক্ষে পারিবারিক পর্যায়ে এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার, প্রত্যেকটা মানুষের মতামত আর অস্তিত্বকে সম্মান করার। বুকভরে শ্বাস নিয়ে নিজের চিন্তা, বিচারবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার স্বাধীনতাকে সামাজিক আর পারিবারিক স্বীকৃতি দেওয়ার।</p> <p> </p> <p>লেখক : বহুজাতিক কম্পানিতে কর্মরত বিপণন যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ</p>