দখলে-দূষণে অস্তিত্বসংকটে কুমিল্লার খরস্রোতা গোমতী নদী। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের মাঝে চলছে নদী দখলের প্রতিযোগিতা। কুমিল্লা ৯৭ কিলোমিটার অংশে নদীকে শাসন করছেন তাঁরা। নদীগর্ভ ও দুই পারে গড়ে তুলেছেন বিনোদন পার্ক, রেস্টুরেন্ট, বাণিজ্যিক ও আবাসিক বহুতল ভবন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ছোট-বড় অসংখ্য স্থাপনা।
পাশাপাশি রাতের আঁধারে বেড়িবাঁধসংলগ্ন এলাকা ও নদীর চর থেকে অসাধু ব্যক্তিরা মাটি কেটে নদীকে করেছে ক্ষতবিক্ষত। এতে উজানের সামান্য পাহাড়ি ঢলে ফুলে-ফেঁপে ওঠে নদীর পেট। বর্ষা মৌসুমে নদী পারের মানুষের বাড়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় প্রভাবশালীরা এই সব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
এদিকে অবৈধভাবে গোমতী নদী দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ২০১১ সালে একটি রিট আবেদন করা হয়। জনস্বার্থে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি ছিল গত ৩ আগস্ট। শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ অবৈধ দখল-স্থাপনা আগামী ছয় মাসের মধ্যে উচ্ছেদ করতে কুমিল্লার জেলা প্রশাসকের প্রতি এ নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে কেউ যাতে গোমতী নদী দখল বা নদী ভরাট না করতে পারে, সে জন্য কুমিল্লার পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদারকি করতে বলা হয়।
হাইকোর্টের রায়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আগামী তিন মাসের মধ্যে নদী ড্রেজিংয়ের প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিন কুমিল্লা সদর উপজেলার গোমতী নদীর গোলাবাড়ি, বিবির বাজার, অরণ্যপুর, সাহাপুর, টিক্কার চর, চাঁনপুর, পালপাড়া, ছত্রখীল, রত্নবতী, ভাটপাড়া, বদরপুর, জালুয়াপাড়া, বানাশুয়া, আড়াইওড়া, দুর্গাপুর, বুড়িচং উপজেলার কংশনগর, বালিখাড়া, ভান্তি, বুড়বুড়িয়া থেকে গোবিন্দপুর, দেবিদ্বার ও মুরাদনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর ভেতর অসংখ্য ছোট-বড় অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে বিনোদন পার্ক, রেস্টুরেন্ট, কফিশপ, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল, বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনসহ কয়েক হাজার অবৈধ স্থাপনা রয়েছে।
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ডুমুরিয়া চাঁনপুর এলাকায় জাতীয় পার্টির সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি অধ্যক্ষ রওশন আরা মান্নান নদী দখল করে তাঁর বাবার ও নিজের নামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, গোমতীর তীরে বলপ্রয়োগ কিংবা অবৈধভাবে আমি কোনো স্থাপনা নির্মাণ করিনি।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে লিখিত অনুমতি নিয়েই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। ভাটপাড়া এলাকায় কুমিল্লা পৌরসভার (বর্তমানে সিটি করপোরেশন) সাবেক কমিশনার মো. আকছিরুল বাশার সোহাগও একটি মাদরাসা নির্মাণ করেছেন। তিনি বলেন, সবার জায়গা যদি উচ্ছেদ হয়, তাহলে আমার জায়গাও হবে।
দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন জাফরগঞ্জ বাজারসংলগ্ন ইউনিয়ন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশেই নদীর জায়গা দখল করে একটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করেছেন। তবে তাঁর দাবি, সরকারি জায়গা হলে তিনি ফেরত দেবেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক নেতাই গোমতী দখল করেছেন। তবে তাঁদের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁদের কেউ পলাতক, কেউ বা ফোনে সাড়া দেননি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. হুমায়ুন কবীর মাসউদ কালের কণ্ঠকে বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের রায়কে সম্মান জানিয়ে, স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এটাই আমার বিশ্বাস।
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরনো গোমতীর মানচিত্র ধরে জরিপ করে সব দখলি ভূমি উদ্ধার করে জনস্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, শত ভাগ অবৈধ স্থাপনা কখনো উচ্ছেদ করা যাবে না। তবে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। তবে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আমিরুল কায়ছার কালের কণ্ঠকে বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী নদীর ম্যাপ অনুসরণ করে ৫০৮ হোক, আর দুই হাজার হোক, সব উচ্ছেদ করা হবে।