সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরির সব গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে ৯৩ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ নিয়োগ হবে কোটার ভিত্তিতে। গতকাল মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে—‘সরকার এই মর্মে আদেশ জারি করিতেছে যে সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব লাভ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, অর্থাৎ সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকুরিতে বা কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে ৯৩ শতাংশ।
’
গতকাল বিকেলে রাজধানীর গুলশানে আইনমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে কোটাসংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল ইসলাম চৌধুরী এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
এ সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আপিল বিভাগের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন বদলানোর ক্ষমতা আমাদের নাই।
এই মুহূর্তে আদালতের রায়ে হাত দিলে আইনের শাসনের প্রতি মারাত্মক ভুল হবে। তাই এটা আমরা করিনি। তবে পরবর্তী সময়ে সংশোধনের সুযোগ আছে। যদি প্রয়োজন মনে করা হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে সংশোধন হতে পারে।’
কোটাসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন কবে কার্যকর হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট বলা আছে, এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। জনপ্রশাসনমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। কারণ আদালতও এ আদেশ দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। সর্বোচ্চ আদালত বিচক্ষণ রায় দিয়েছেন। কোটাসংক্রান্ত আইন পাসের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো দিন কোটাসংক্রান্ত আইন ছিল না। এটা রাষ্ট্রের পলিসির বিষয়। তাই পরিপত্র এবং প্রজ্ঞাপন দিয়েই বলা হতো।
নারী কোটার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যে নারীরাই বলেছেন, তাঁরা (নারীরা) অত্যন্ত ক্ষমতাবান হয়েছেন। আদালত যদি আন্দোলনকারীদের দাবি বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।’ তিনি বলেন, ‘আগে যে সহিংসতা হয়েছে, সেটা তদন্তের জন্য এক সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি কাজ করছেন। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে তিনি স্থানগুলো ঘুরে দেখবেন। এই যে সহিংসতা হয়েছে, এতে যাঁরা সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার দেখভাল করবে। মামলার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কথা আছে—এ জন্য মামলার তথ্যাদি যদি তাঁরা (শিক্ষার্থীরা) আমাদের দেন, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মামলাগুলো অবশ্যই আমরা দেখব। শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে সরকার। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী আন্দোলন করছিলেন। সরকার কোটা সংস্কার করেছে। এখন তাঁদের নিজ নিজ স্থানে ফিরে যেতে আহ্বান করব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে আমরা সচেষ্ট। এ জন্য আশা করতে পারেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে যাবে।’
তবে প্রজ্ঞাপন জারির পর কোটাবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের একাংশ তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করেই প্রজ্ঞাপন জারির সমালোচনা করেছে। এ ছাড়া তারা কয়েকটি দাবিও তুলে ধরেছে।
শিক্ষার্থীদের নিহতের সংখ্যা অ্যাসেসমেন্ট করছি : শিক্ষামন্ত্রী
এই আন্দোলনে এখন পর্যন্ত কতজন মারা গেছে এবং যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত—এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার্থীর সংখ্যাটা নিরূপণ (নিহতের সংখ্যা) করা যাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার পর। এর আগেই আমরা একটা অ্যাসেসমেন্ট করছি। আমরা এখন দেখছি যে কিছুটা আছে তথ্য, কিছুটা আছে অপতথ্য, কিছুটা আছে গুজব। এই যে তথ্যে বিভ্রাট, সেটাকে ব্যবহার করেই জনমনে সার্বক্ষণিক এক ধরনের আবেগ-উত্তেজনা বা সেটাকে ব্যবহার করে নাশকতামূলক কাজগুলোর ক্ষেত্রে জাস্টিফিকেশন করা হয়েছিল। সুতরাং এই পরিস্থিতি বর্তমানে পরিবর্তন হওয়ার পরই আমাদের পক্ষে সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হবে—আসলে কারা কারা শিক্ষার্থী ছিলেন এবং শিক্ষার্থী কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ছিলেন। এই মুহূর্তে নিরূপণ করা খুবই কঠিন।’
হল খুলে দিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে—এ ব্যপারে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এ রকম কোনো আলটিমেটাম আমরা পাইনি।’
‘বিএনপি-জামায়াত-শিবির এই আন্দোলনে পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা করেছে’
তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘যেহেতু শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা ঢোকানোর পরিকল্পনা তারা (বিএনপি-জামায়াত-শিবির) আগে থেকেই করেছে, কাজেই তাদের প্রস্তুতি ছিল—তারা ডাটা সেন্টার জ্বালিয়ে দেবে, দেশকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। ইন্টারনেটের অনুপস্থিতিতে আমরাও (সরকার) তো বিপদে পড়েছি। আমরা কিন্তু গ্লোবালি যোগাযোগ করতে পারিনি। আমরা যখন পারিনি, তখন তাদের যে সিন্ডিকেট এবং মিস ইনফরমেশন (ভুল তথ্য)—আপনারা চেনেন তারা কারা, তারা কিন্তু বিদেশ থেকে মিস ইনফরমেশনটা ছড়িয়েছে। যেহেতু তারা জানত তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ইন্টারনেটবিচ্ছিন্ন করবে, তারা কিন্তু ব্যাক-আপ রেখেছিল। তারা কিন্তু এগুলো পাঠিয়েছে। এটারই প্রতিফলন দেখছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া ভুল তথ্যগুলো এই কারণে দিচ্ছে। আমি একটু আগে দেখলাম ওয়ান সাইডেড (একপক্ষীয়) একটি ভুল তথ্য তারা দিচ্ছে।’
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘাত ও নাশকতার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনো ব্যর্থতা ছিল কি না—জানতে চাইলে তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার যা বলেছিল, তাই কিন্তু হলো। সরকার বলেছিল একটু ধৈর্য ধরুন, আদালতে আছে বিচারাধীন বিষয়, এটা সমাধান হয়ে যাবে। আপনারা আশাহত হবেন না। প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেছেন। তা তো হলো। একটু ধৈর্য ধরলে, তাদের যে অধৈর্য বা তাদের যে রাস্তায় ক্রেজিনেসের সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসীরা ঢুকে যে কাজটি করল, এটা আসলে আমরা কেউ আশা করিনি।’
তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ভেতরে জামায়াত-শিবির ঢুকেছে। ঢুকে তারা আক্রমণ শুরু করেছে। সরকার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল আক্রান্ত। বিটিভি আক্রান্ত ছিল, সেতু ভবন আক্রান্ত ছিল, ডাটা সেন্টার আক্রান্ত ছিল, টোল প্লাজা আক্রান্ত ছিল। যখন আমি বিটিভি থেকে ফোন পাচ্ছি, তাঁরা কাঁদছেন, তাঁদের জীবন বিপন্ন। স্যার বাঁচান। পুলিশ পাঠাতে হয়েছে। সেই পুলিশকে আক্রমণ করেছে। আক্রান্ত যখন আপনি হবেন, তখন আত্মরক্ষার্থে ফাইটব্যাক করতে হবে। যখন আমরা ফাইটব্যাক করেছি, তখন আক্রমণকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ তৈরি হয়েছে। সে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কাজেই আমরা বলতে চাই, যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আক্রমণকারীরা দায়ী। বিচার করে প্রত্যেককে সে যে-ই হোক, সাজার আওতায় আনা হবে। এটি আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য।’