সরকারি চাকরিতে কোটা ৭ শতাংশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
সরকারি চাকরিতে কোটা ৭ শতাংশ

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে এবং ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৮ সালে ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হাইকোর্টের রায় বাতিল করে গতকাল রবিবার এ রায় দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নের্তৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

সরকারি চাকরিতে কোটা ৭ শতাংশরায়ে বলা হয়েছে, যদিও কোটা নির্ধারণের বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বিষয়। তার পরও সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের এখতিয়ারবলে, সার্বিক ও যৌক্তিক বিবেচনায়, ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮(৪), ২৯(১) ও ২৯(৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য কোটা প্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।

তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অবিলম্বে গেজেট বা প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ দেওয়া হলো। তবে এই নির্দেশনা ও আদেশ থাকার পরও সরকার প্রয়োজনে আদালত নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে।

২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষণ করা হতো।

এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ছিল ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ কোটা।

এই কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ছয় বছর আগে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। সে সময় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন নুরুল হক নুরসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ২ জুন একটি কমিটি করে সরকার।

সব কাজ শেষে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোনো কোটা না রেখে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করতে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ জমা দেয় কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর ৩ অক্টোবর তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হলে সেখানে কোটা বাতিলের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। পরদিন ৪ অক্টোবর কোটা পদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করেন জনপ্রশাসন সচিব।

পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের (আগের দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে।

২০২১ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিলের এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন। রিটে প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ওই বছর ৭ ডিসেম্বর রুল জারি করেন। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত (২০১৩ সালের) উপেক্ষা করে কোটা পদ্ধতি বাতিল করা পরিপত্র কেন স্বেচ্ছাচারী ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে। মন্ত্রিপরিষদসচিব, জনপ্রশাসনসচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যানসহ পাঁচ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। সেই রুলের চূড়ান্ত শুনানির পর গত ৫ মে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন উচ্চ আদালত। এই রায়ের পর ফের কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রথম কয়েক দিন আন্দোলনকারীরা রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এদিকে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে সরকার আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে। কিন্তু চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপ না করে আবেদনটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। এতে আন্দোলনকারীরা আরো সংক্ষুব্ধ হয়ে তারা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। গত ৪ জুলাই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। শুনানির পর সর্বোচ্চ আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে নো অর্ডার দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলেন। রাষ্ট্রপক্ষের এই লিভ টু আপিল করার অপেক্ষার মধ্যে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে ৯ জুলাই আবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। সে আবেদনে শুনানির পর গত ১০ জুলাই কোটা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেন সর্বোচ্চ আদালত। সব পক্ষকে এই স্থিতাবস্থা মেনে চলতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই স্থিতাবস্থা আদেশের ব্যাখ্যায় আদালত বলেন, ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল, সেই পরিপত্রের ওপর স্থিতাবস্থা। অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ের আগে পরিপত্রটির যে কার্যকারিতা ছিল সেই কার্যকারিতা থাকবে। অর্থাৎ সরকার চাইলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা ছাড়া নিয়োগ দিতে পারবে। আদালত ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলেন শিক্ষার্থী দুই আবেদনকারীকে।

এই আদেশের পর আন্দোলনকারীরা সরকারি চাকরির সব ধরনের কোটা বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পাশাপাশি সরকারকে কোটা সংস্কারের আলটিমেটাম দেন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আশ্বস্ত করে আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। তাঁরা আরো বলেছিলেন, আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকার চাইলেই কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। তাঁদের এমন বক্তব্যে আন্দোলনকারীরা কঠোর অবস্থানে যান। তত দিনে আন্দোলন ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাঙ্গন থেকে অবরোধের খবর আসতে থাকে।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ জুলাই বাংলা ব্লকেড (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচির ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। সেদিন এই কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে আন্দোলনকারীসহ ছয়জনের মৃত্যুর খবর জানা যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় পরদিন টোটাল শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাতের সঙ্গে মৃত্যুও বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৪ জুলাই হাইকোর্টের রায় প্রকাশ পায়। ১৬ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায় বাতিল চেয়ে লিভ টু আপিল করে। এদিকে বাড়তে থাকে সংঘাত ও প্রাণহানি। স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনজীবন। সরকারি স্থাপনায় হামলা-লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। এ অবস্থায় গত ১৮ জুলাই সরকারের আইনমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার ঘোষণা দেন। আর অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দেন লিভ টু আপিলের শুনানি এগিয়ে আনার আবেদন করতে। ওই দিনই আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করলে আদালত রবিবার সকাল ১০টায় লিভ টু আপিলের শুনানির সময় দেন। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির মধ্যে সরকার কারফিউ ঘোষণা করে সেনাবাহিনী মাঠে নামায় এবং সোমবার পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। গতকাল সাধারণ ছুটি ও কারফিউয়ের মধ্যে লিভ  টু আপিলের শুনানির পর রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। এ ছাড়া কোটা এবং কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়, আদালতের এখতিয়ার নিয়ে মতামত তুলে ধরেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ, জেড আই খান পান্না, জয়নুল আবেদীন, এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকন, আহসানুল করিম, তানিয়া আমীর, সারা হোসেন ও আইনজীবী তানজীব উল আলম।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৫ আগস্ট প্রথম কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে সরকার। ২০১৩ সালে আপিল বিভাগ যখন ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত দেন, তখন কোটা পদ্ধতি ছিল। ২০১৮ সালে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোটা পদ্ধতিটিই বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে কোটা থাকবে না। হাইকোর্ট এখন যখন কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে রায় দিলেন, তখন তো কোটা পদ্ধতিই নেই এবং আপিল বিভাগের সর্বশেষ (২০২২ সালের রায় অনুসারে) সিদ্ধান্ত অনুসারে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এমনকি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত কোনো পরামর্শও দিতে পারেন না, যদি না সে সিদ্ধান্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে, সংবিধানকে লঙ্ঘন করে। ফলে হাইকোর্টের রায়টি (গত ৫ মে কোটা পুনর্বহালের রায়) বাতিল করা হোক।

আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে বলেন, হাইকোর্ট রায়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর অংশ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা বরাদ্দ করা হয়েছে বিশেষ মর্যাদায়, অনগ্রসর হিসেবে নয়। মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই অনগ্রর হতে পারেন না। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং সবচেয়ে অগ্রগামী অংশ। তা ছাড়া সংবিধানের কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি, বরং বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল চাচ্ছি। পাশাপাশি কোটার যৌক্তিক সংস্কার চাচ্ছি। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ন্যায়বিচারের স্বার্থে সর্বোচ্চ আদালত সে আদেশ দিতে পারেন।

রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী শুনানিতে বলেন, ১৯৭৫ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সুবিধা দেওয়া হলেও পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর এই কোটার কোনো বাস্তবায়ন ছিল না। মানছি কোটা পদ্ধতি রাখা না রাখা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়, কিন্তু ২০১৮ সালে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করে আর সব শ্রেণির চাকরিতে কোটা বহাল রাখল। এটা হতে পারে না। সরকারের এ রকম নীতিগত সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক? ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কারণ তো থাকা দরকার ছিল।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ শুনানিতে বলেন, কোটা পদ্ধতি নিয়ে হাইকোর্ট তাঁর রায়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন, কিন্তু এই হস্তক্ষেপের বিষয়ে রায়ে কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ফলে রায়টি বাতিল করা হোক।

আইনজীবী আহসানুল করিম তাঁর মতামত তুলে ধরে শুনানিতে বলেন, আমাদের সংবিধান যাঁরা প্রণয়ন করেছেন, তাঁরা কখনোই মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর অংশ হিসেবে বিবেচনা করেননি। সে জন্য তাঁদের অনগ্রসর অংশ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কোটা ও মেধার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে মেধাই প্রাধান্য পাবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনির কোটা সুবিধা দেওয়া নিয়ে আইনজীবী তানিয়া আমীর বলেন, যাদের জন্মই হয়নি, তারা কিভাবে অনগ্রসর হয়? তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কখনোই অনগ্রসর হতে পারেন না। যদি তা না হয়, তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বা নাতি-নাতনি কিভাবে অনগ্রসর হয়? তা ছাড়া যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকে, তাহলে তা কত দিন থাকবে? তা ছাড়া যিনি রিট করেছেন, তাঁদের এই রিট করার এখতিয়ার আছে কি না।

আপিলের অনুমতি না দিয়ে (লিভ টু আপিল গ্রহণ না করে) হাইকোর্টের রায়ের ওপর চূড়ান্ত শুনানি করা যায় কি না সে প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানজীব-উল আলম শুনানিতে বলেন, আমি মনে করি, লিভ টু আপিল গ্রহণ না করেই হাইকোর্টের রায় নিয়ে আপিল বিভাগে শুনানি হতে পারে। এমনকি হাইকোর্টের রায় বাতিলও করতে পারে। তা ছাড়া কোটা নিয়ে হাইকোর্ট যে বিষয়ে রুল জারি করেছিলেন, তার বাইরে গিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আর নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সরকারকে কোনো পরামর্শ দিতে পারেন না হাইকোর্ট। সুতরাং রায়টি বাতিল করা উচিত।

আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকন অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে একমত পোষণ করে শুনানিতে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮%, বেড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮%, বেড়েছে  জিডিপি প্রবৃদ্ধি

বহুদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা। প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে। তবে অবশেষে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা গত ৩৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি নেমেছিল ৮.৯১ শতাংশে।

গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে এই চিত্র উঠে এসেছে। ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.০৫ শতাংশ, জুনে তা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

মূল্যস্ফীতির এই পতন দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির বার্তা বয়ে আনলেও বাজারের বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। চাল, সবজি, মাছসহ খাদ্যপণ্যের দামে আগুন। তাই পরিসংখ্যানগত স্বস্তি বাস্তব জীবনে এখনো প্রতিফলিত হয়নি।

 

খাদ্যমূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে

বিবিএসের ভোক্তা মূল্যসূচক অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুনে নেমে এসেছে ৭.৩৯ শতাংশে, যা মে মাসে ছিল ৮.৫৯ শতাংশ।

একইভাবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৭ শতাংশে।

তবে বাজারের চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ঢাকার খুচরা বাজারে মিনিকেট চালের দাম বেড়ে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা/কেজিতে পৌঁছেছে, যেখানে ঈদের আগে তা ছিল ৭২ থেকে ৮২ টাকা। মাঝারি মানের চাল ব্রি২৮ এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৪ টাকা কেজি দরে, যা আগের তুলনায় তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন সবজির দাম ৭০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।

মাছের দামেও দেখা যাচ্ছে ১০ থেকে ৫০ টাকার বৃদ্ধি। এ অবস্থায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার ঘোষণা ভোক্তা পর্যায়ে স্বস্তি দিতে পারেনি।

 

আয় বেড়েছে কম, ব্যয় বেড়েছে বেশি

মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে এক ধরনের অদৃশ্য কর-এর মতো। বিশেষ করে মজুরিনির্ভর মানুষের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে। বিবিএসের তথ্য মতে, জুনে জাতীয় মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.১৮ শতাংশে, কিন্তু একই সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮.৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয় বৃদ্ধির চেয়ে ব্যয় বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় প্রকৃত আয় কমেছে।

 

প্রবৃদ্ধিতে ফিরছে গতি

মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) স্থির মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪.৮৬ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৪.৪৮ শতাংশ।

তবে পুরো অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) প্রথম তিন প্রান্তিক মিলিয়ে গড় প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৮১ শতাংশ। এই ধীরগতির প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সতর্কবার্তা আগেই দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বিশ্বব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৩ শতাংশ, আর এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী এটি ৩.৯ শতাংশ।

প্রবৃদ্ধির খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাত কিছুটা উন্নতি করলেও গতি কমেছে শিল্প খাতে। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৪২ শতাংশ, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৪ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.৯১ শতাংশে, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৭.১০ শতাংশ। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক ভালো৫.৮৮ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৪.৩১ শতাংশ। চলতি মূল্যে এই প্রান্তিকে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি পরিসংখ্যান বলছে মূল্যস্ফীতি কমেছে, প্রবৃদ্ধিও কিছুটা বাড়ছে। তবে বাজারে এর প্রতিফলন নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী, মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে, ফলে মানুষের বাস্তব আয়ে ঘাটতি রয়ে গেছে।

মন্তব্য
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

শেখ হাসিনা-কামালকে অব্যাহতির আরজি মামুনের বক্তব্য নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
শেখ হাসিনা-কামালকে অব্যাহতির আরজি মামুনের বক্তব্য নেই

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক উপাদান (প্রাইমা ফেসিয়া) পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্র নিযু্ক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। মামলার অভিযোগ থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানান তিনি।

এ সময় আদালতে উপস্থিত আরেক আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেননি এবং অভিযোগ থেকে তাঁর অব্যাহতিও চাওয়া হয়নি।

গতকাল সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ অভিযোগ গঠনের শুনানি চলাকালে আমির হোসেন ওই আরজি তুলে ধরেন।

তবে অভিযোগ গঠন করে আসামিদের বিচার শুরু করার আরজি জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম।

শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল আগামী ১০ জুলাই আদেশের তারিখ ধার্য করেন। এর আগে গত ১ জুলাই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ করে প্রসিকিউশন।

ওই দিন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন মামলার অভিযোগ থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন : দাবি আইনজীবীর

অব্যাহতির আবেদনের শুনানিতে আমির হোসেন প্রসিকিউশনের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য দেননি। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। সেই জবাবেও তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা রাজাকারের নাতি-পুতি বলেননি।

আন্দোলনে নিহতদের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর সঠিক কারণ লিখতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, মৃতদেহ হস্তান্তর না করে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গণদাফন, লাশ গুম করে ফেলার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া বলে উল্লেখ করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী। তিনি বলেন, এসব অভিযোগের দালিলিক কোনো প্রমাণ নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানিতে প্রসিকিউশন বলেছিল, জুলাই গণ-আন্দোলন চলার সময় বিটিভি ভবন, মেট্রো রেলসহ কেপিআইভুক্ত (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়েছে। এই অভিযোগও অস্বীকার করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।

তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় মেট্রো রেলসহ যেসব স্থাপনায় হামলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এইসব স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। এইসব স্থাপনায় হামলা ও ধ্বংসের কারণে তিনি তখন বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। ব্যথিত হয়েছিলেন। এমনকি তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনেও গিয়েছিলেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় গত বছর ১৬ জুলাই রংপুরে গুলিতে শহীদ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধ প্ররোচনা, সহায়তা ও ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অস্বীকার করে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ আবু সাঈদের মা-বাবা, ভাই-বোনদের গণভবনে এনে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।

গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এই আইনজীবী বলেন, আন্দোলনের সময় পুলিশ মানুষের জানমাল রক্ষার স্বার্থে দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আন্দোলনে বহু মানুষ হতাহত হওয়ার নজির আছে। কিন্তু এর জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে কোনো দেশ বিচার করেছেএমন নজিরও নেই।

জুলাই গণ-আন্দোলনে আসামিদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটিকে মিথ্যা দাবি করে আমির হোসেন বলেন, গণ-আন্দোলনের সময় এবং সরকার পতনের পরে দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালানো হয়েছে, থানা লুট করা হয়েছে। এমনকি পুলিশ হত্যা করা হয়েছে। ফলে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মনগড়া। পরে তিনি অভিযোগ থেকে তাঁদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) অব্যাহতি দেওয়ার আরজি জানান।

ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ১৪ আগস্ট সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়। তদন্ত শুরু হয় গত বছর ১৪ অক্টোবর। ছয় মাস ২৮ দিনে তদন্ত শেষে গত ১২ মে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ব্যপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। গত ১ জুন প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করলে তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

মন্তব্য
মানবতাবিরোধী অপরাধ

চলতি বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলার বিচার

মেহেদী হাসান পিয়াস
মেহেদী হাসান পিয়াস
শেয়ার
চলতি বছর শেষ হতে পারে ৪ মামলার বিচার

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যেসব মামলা হয়েছে, এর মধ্যে অন্তত চারটি মামলার বিচারকাজ চলতি বছর শেষ হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। চারটি মামলার অভিযোগই আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। তবে মামলার তদন্ত ও বিচারে সময় নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে ভুক্তভোগী এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের।

চার মামলায়ই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। তিনিসহ এই চার মামলায় মোট আসামি ৫৭ জন। তাঁদের মধ্যে পলাতক ৪১ জন। গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে ১৬ জনকে।

এ ব্যাপারে প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, চারটি মামলা আনুষ্ঠনিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। তার মধ্যে দুটি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করলে বিচার হবে। অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতি দিলে মামলা ওইখানেই শেষ।

আর যদি ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী আসামিপক্ষকে প্রস্তুতির জন্য ২১ দিন সময় দিতে হবে। প্রসিকিউশন থেকে আমাদের আরজি থাকবে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সূচনা বক্তব্য এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করার জন্য। যদি ট্রাইব্যুনাল আবেদন মঞ্জুর করেন, তাহলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।

বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে আইনি বিধান তুলে ধরে এই প্রসিকিউটর বলেন, আইনে আছে, অভিযোগ গঠনের পর বিচার শুরু হলে তা চলবে বিরতিহীনভাবে। কোনো পক্ষ মুলতবির আবেদন করতে পারবে না।

সব মিলিয়ে আশা করছি, চলতি বছরই চারটি মামলার বিচারকাজ শেষ হতে পারে।

নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় বা তদন্ত সংস্থায় লিখিত অভিযোগ দিতে হয়। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে মামলা হিসেবে তা নথিভুক্ত করে তদন্ত সংস্থা। এরপর অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই, পর্যালোচনা করে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হিসেবে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। পরে এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গ্রহণ করে তা আমলে নিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর। অভিযোগ আমলে নেওয়া হলে আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যে চার মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থান চলার সময় পরিকল্পিতভাবে ড্রোন, হেলিকপ্টার, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূলের অভিযোগ রয়েছে একটি মামলায়। মামলাটি ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দায় বা সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এই মামলার আসামি। তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে রাখা হয়েছে। অন্য দুজন পলাতক। এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ১০ জুলাই আদেশের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ঘটনা ও অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বাকি তিনটি মামলাও বেশ আলোচিত।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলাটিকে আবু সাঈদ হত্যা মামলা হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। গত ৩০ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১০ জুলাই এ মামলায় পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। এ মামলার ৩০ জন আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার চারজন। বাকি ২৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলাটিকে বলা হচ্ছে চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ড মামলা। সরকার পতনের আন্দোলন মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন ছয় তরুণ। গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ তাঁদের গুলি করে হত্যা করে। সেদিন শহীদ হন শাহরিয়ার খান আনাস, শহীদ শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মো. ইয়াকুব, শহীদ মো. রাকিব হাওলাদার, শহীদ মো. ইসমামুল হক ও শহীদ মানিক মিয়া। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ছয় মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে গত ২০ এপ্রিল প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এটিই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। গত ২৫ মে এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। গত ৩ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ হয়। আগামী ১৪ জুলাই এ বিষয়ে শুনানির তারিখ ধার্য করা রয়েছে। মামলার আট আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে চারজনকে।

আশুলিয়ায় মৃতপ্রায় একজন ও পাঁচজনের লাশ পোড়ানোর মামলাটি লাশ পোড়ানোর মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত ১৯ জুন চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় তদন্ত সংস্থা। গত ২ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেদিনই তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলার ১৬ জন আসামির মধ্যে ট্রাইব্যুনালে ১১ জনের নাম প্রকাশ করে প্রসিকিউশন। এই ১১ জনের মধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে।

প্রত্যাশার সঙ্গে আছে হতাশা

মামলার তদন্তকাজ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করলেও বিচার নিয়ে আশাবাদী শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা এই বিচারটা দেখতে পাব এবং ন্যায়বিচার পাব। কিন্তু তদন্তেই দীর্ঘ সময় লাগল। তার পরও বলতে চাই, যারা আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের সবার বিচার চাই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কাউকে যেন এ মামলায় যুক্ত না করা হয়।

শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় দেশ পলিটেকনিক কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসান আলভীর। পরে ১৯ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন শহীদ আলভীর বাবা মো. আবুল হাসান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, অভিযোগটি কী পর্যায়ে আছে, জানি না। গত সপ্তাহেও আমি প্রসিকিউশনে গিয়েছিলাম। গেলে শুধু একটা কথাই বলে, কাজ করছি, বিচার হবে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কি নাজানি না। আসামিরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে আমরা হতাশায় ভুগছি।

মামলার বাদী এবং শহীদ পরিবারগুলোর জন্যও বিশেষ নিরাপত্তার দাবি জানান আবুল হাসান। 

প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, এই অভ্যুত্থানের সময় দেশজুড়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে ২৭টি পর্যন্ত মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মন্তব্য

বৃহস্পতিবার এসএসসির ফল প্রকাশের প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
বৃহস্পতিবার এসএসসির ফল প্রকাশের প্রস্তাব

আগামী ১০ জুলাই বৃহস্পতিবার এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তাব করেছে আন্ত শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি। এরই মধ্যে এই প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে সম্মতি পেলে ফল প্রকাশ করা হবে।

আন্ত শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহবায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী ১০ জুলাই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রস্তাব করা হয়েছে।

তবে ওই দিন বা এর আগে-পরে যেদিন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সম্মতি দেওয়া হবে, সেদিনই ফল প্রকাশ করা হবে। আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

সূত্র জানায়, সাধারণত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা হয়ে থাকে। গত ১০ এপ্রিল সারা দেশে একযোগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়।

এসএসসির লিখিত পরীক্ষা শেষ হয় ১৩ মে। ব্যাবহারিক পরীক্ষা ১৫ থেকে ২২ মের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে মাদরাসা বোর্ডের দাখিলের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয় ১৫ মে। সেই হিসাবে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ফল প্রকাশের সময় রয়েছে।

জানা গেছে, এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন। এর মধ্যে সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার ১৪২ জন। অন্যদিকে মাদরাসা বোর্ডের অধীন দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে দুই লাখ ৯৪ হাজার ৭২৬ জন। আর কারিগরি বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৩১৩ জন।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ