<p>কৃষিতে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস ও ভবিষ্যতের নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপ করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব অধ্যাপক ড. জহুরুল করিম। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন <strong>সাইদ শাহীন</strong></p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : বর্তমান কৃষির অর্জন ও সংকটকে কিভাবে দেখছেন?</p> <p>অধ্যাপক ড. জহুরুল করিম : কৃষিতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে উন্নতি হয়েছে। গত কয়েক দশকে দেশের খাদ্যশস্যের মধ্যে দানাদার কিছু শস্য ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ সফলতা দেখিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে শস্যের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সফল হয়েছি আমরা। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিজ্ঞানী ও গবেষক তৈরি হয়েছে। তবে সেই উন্নতি ধরে রাখার পাশাপাশি সামনের দিনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণে কৃষিতে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। সংকট এখন এমন পর্যায়ে রয়েছে, দ্রুত জরুরিভাবে ব্যবস্থা না নিলে দেশের কৃষিতে মহাবিপদ আসতে বাধ্য। দেশের প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমরা একেবারেই উদাসীন। নদী, মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনায় আমাদের দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই। আবার কিছু নীতি-পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : কৃষিতে এই ‘মহাবিপদ’ বা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা কোথায় দেখছেন?</p> <p>অধ্যাপক ড. জহুরুল করিম : কৃষির সঙ্গে যুক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছি আমরা। প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের প্রভাব সর্বব্যাপী হবে। নদীতে পানি নেই। নদী হলো একটি দেশের লাইফলাইন বা প্রাণপ্রবাহ। নদীর নাব্যতা সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ সীমিত। সার্বিকভাবে এগুলোর কারণে শস্য উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়বে। দেশের বিজ্ঞানী, গবেষকরা দেশে থাকতে চাচ্ছেন না। আবার মাটির উর্বরাশক্তি ধরে রাখতে পারছি না। মাটিকে আমরা মেরে ফেলছি। আবার জলবায়ুর পরিবর্তনের নানামুখী ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরই মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। কৃষির জন্য সার্বিকভাবে ইকোসিস্টেম খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা আমরা রক্ষা করতে পারছি না। ভূগর্ভস্থ পানির টেকসই ব্যবস্থাপনায় আমরা এখনো উদাসীন। কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে চলেছে। এ কারণে অনেক নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। বেশির ভাগ অঞ্চলেই মাটির অনেক গভীরে যেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও ইচ্ছামতো কিন্তু খাবার কিনতে পারব না। বিশ্বে যদি খাদ্য উদ্বৃত্ত না থাকে তাহলে খাবার আনবেন কোথা থেকে? ফলে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি দরকার। বিশেষ করে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : কৃষিতে মেধাবী বিজ্ঞানী ও গবেষকদের ধরে রাখা যাচ্ছে না কেন? এটার কারণে কী ক্ষতি হতে পারে?</p> <p>অধ্যাপক ড. জহুরুল করিম : কৃষির অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। গবেষক ও বিজ্ঞানী তৈরিতে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। বিজ্ঞানীদের বিদেশ চলে যাওয়া বন্ধ না করতে পারলে কৃষি মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রতিবছর একটি বৃহত্সংখ্যক বিজ্ঞানী-গবেষক দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসছেন না। এটি দেশের জন্য অশনিসংকেত। কৃষিশিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন এবং ভালো ছাত্র-ছাত্রী যাঁরা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করছেন, তাঁদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন। তবে সেখান থেকে যাতে তাঁরা ফিরে আসেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য দেশে এসে যাতে তাঁরা সুবিধা ও পছন্দমতো কাজ করার প্রণোদনা পান, সে নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিদেশি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে আমাদের। এটা সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, বিশেষ করে জিনোম এডিটিং কাজে লাগাতে হবে।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : কৃষির উন্নয়নে মাটির উর্বরাশক্তি ধরে রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?</p> <p>অধ্যাপক ড. জহুরুল করিম : মাটি হলো শস্যের মা। সেই মাকে পুষ্ট রাখতে না পারলে কৃষির জন্য বিপদ বাড়বে। মাটি প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। আবার প্রতিবছর বিশাল আবাদি জমি অকৃষি কাজে ব্যবহারে চলে যাচ্ছে। ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা ও অম্লতা বৃদ্ধি, মাটির পুষ্টি উপাদান হ্রাস, ভারী ধাতু দূষণ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা, টেকসই কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা ও পানির সহজলভ্যতা বাড়াতে সুষ্ঠু মাটি বা ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। গুণগত কৃষিজমি রক্ষাই হবে আগামীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়, খাদ্যপণ্যের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পথে প্রধান বাধা। তাই ভূমির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে জোরদার করতে হবে।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : গবেষণা ও সম্প্রসারণকর্মীদের মধ্যে সমন্বয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ?</p> <p>অধ্যাপক ড. জহুরুল করিম : প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন—বন্যা, খরা, লবণাক্ততাসহ নানা কারণে দেশের যেসব স্থানে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। এরই মধ্যে খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানের উদ্ভাবন হয়েছে। কিন্তু জাতগুলো দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে। বিশেষ করে জাত উদ্ভাবনে সময় গ্যাপ কমিয়ে আনতে হবে। যে মাত্রায় লবণ বাড়ছে সে মাত্রায় লবণসহিষ্ণু জাত দ্রুত আসছে না। আবার যেসব জাত উদ্ভাবন হচ্ছে, সেগুলো মাঠে দ্রুত পৌঁছাচ্ছে না। উন্নত কৃষিশিক্ষার পাশাপাশি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমে যেসব প্রযুক্তি উঠে আসবে, সেগুলো কৃষকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করছে। তাই সার্বিকভাবে গবেষক ও উদ্ভাবক এবং সম্প্রসারণকর্মীদের মধ্যে সমন্বয় রেখেই কাজ করতে হবে, যাতে কৃষক দ্রুত সেটি থেকে সুফল পেতে পারে।</p>