<p>প্রতিটি বস্তুই ক্ষুদ্র কণিকা দিয়ে তৈরি— এই বিশ্বাস প্রাচীন গ্রিকদের সময় থেকেই চলে আসছে। তবে সে আমলে মূল ধারণাটা ছিল ভিন্ন। মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি— চার উপাদানে গঠিত সমস্ত বস্তুজগত। এই ধারণাকে ‘চার উপাদান তত্ত্ব’ বলা হয়। অন্যদিকে কয়েকজন ঠিকই মনে করতেন সমস্ত পদার্থ ক্ষুদ্র, অবিভাজ্য কণিকা বা অ্যাটমস দ্বারা গঠিত। অ্যাটমস গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ভাঙা যায় না— এমন। তত্ত্বটি ‘পরমাণুবাদ তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। পরমাণুবাদ তত্ত্ব চার উপাদান তত্ত্বের কাছে নিছক পাগলামি ছাড়া আর কিছুই ছিল না।</p> <p>উনিশ শতকের শেষ দিকে ক্ষুদ্র কণিকা নিয়ে সত্যিকার অর্থে ভাবতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। তবে কেউ নিশ্চিত ছিলেন না এই ক্ষুদ্র কণাগুলো আসলে কী এবং এদের আচরণ কেমন। অনেকে এদের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ করতেন। পরে দেখা গেল, ক্ষুদ্র কণা কেবল বাস্তবই নয়, বরং এদের আচরণ এমন— যা কেউ কখনো কল্পনাই করেননি।</p> <p>এক সময় বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, ক্ষুদ্র কণা অর্থাৎ পরমাণুর আচরণ চারপাশের সাধারণ বস্তুর মতোই। তবে ছোটো পরিসরে। যেমন, একটা টেবিল টেনিস বলকে দেয়ালে ছুঁড়ে মারলে যেভাবে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, পরমাণুও হয়ত ওভাবেই ফিরে আসবে। ইলেকট্রন আবিষ্কারের পরে জানা গেল পরমাণুই ক্ষুদ্রতম নয়। এর ভেতরেও রহস্য আছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন পরমাণুর ভেতরটা পুডিংয়ের মতো। অর্থাৎ একটা ধনাত্মক তড়িতাহিত গোলক, যার মধ্যে ইলেকট্রনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অনেকটা কেকের মধ্যে কিসমিস্ ছড়িয়ে থাকার মতো। নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের পর সে ধারণাও গেল বদলে। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, পরমাণু হয়ত সৌরজগতের মতো— কেন্দ্রে প্রোটন নামের একটি কণা এবং তার চারপাশে অনেকগুলো ইলেকট্রন ঘুরছে। যেমন ভাবে সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো ঘোরে।</p> <figure class="image"><img alt="পরমাণুর সৌরমডেল" height="424" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/09/22/my1182/II.png" width="600" /> <figcaption>পরমাণুর সৌরমডেল</figcaption> </figure> <p>পরমাণুর গঠন যদি সৌরজগতের মতো হতো, তাহলে আপনি-আমিসহ এই মহাবিশ্বেরই অস্তিত্ব থাকত না। এই মডেল অনুসারে— ধনাত্মক নিউক্লিয়াস ক্রমাগত আকর্ষণ করবে ঋণাত্মক ইলেকট্রনকে। তাতে চোখের পলকেই ইলেকট্রন শক্তি হারিয়ে ঢলে পড়বে নিউক্লিয়াসের বুকে। অগত্যা মৃত্যু ঘটবে পরমাণুর। তাছাড়া একটা পরমাণু টেনিস বলের মতো আচরণ করতে পারে না। কেননা সাধারণ জগত আর অণু-পরমাণুর জগতের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। টেনিস বল দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারলে সে কোথায় আঘাত করবে সেটা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। আবার অঙ্ক কষে এর গতি ও ভর এক সঙ্গে বের করা যায়।</p> <p>কিন্তু টেনিস বলটি যদি ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্র হয়, তখনই আসবে অনিশ্চয়তা। বলটির অবস্থান ও ভরবেগ একই সঙ্গে মাপা যাবে না। এমনকি দেয়াল ফুঁড়েও বেরিয়ে যেতে পারে বলটি। একটি কোয়ান্টাম কণিকা (ইলেকট্রন, ফোটন) এই মুহূর্তে কোথায়, কীভাবে আছে— তা নিখুঁতভাবে জানা অসম্ভব। আন্দাজ করার সুযোগ আছে, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে কণাটি যেসব জায়গায় থাকতে পারে, তার যে কোনো একটা জায়গায় তাকালে সেখানেই কণাটিকে দেখা যাবে। তার মানে এই নয়— দেখার আগে কণাটি ওখানেই ছিল। ব্যাপারটা পাশা খেলার মতো। ডাইস স্থির না হওয়া পর্যন্ত ফলাফল অনিশ্চিত। কাজেই সাধারণ বস্তুর সাথে পরমাণুর তুলনা করা চলবে না।</p> <p>কোয়ান্টাম কণাদের এই অনিশ্চিত আচরণে আইনস্টাইনও বিব্রত ছিলেন। বলেছিলেন— ‘বিজ্ঞান এতটা অনিশ্চিত হবে আগে জানলে বিজ্ঞানী হতাম না, হতাম সরাইখানার বেয়ারা নয়তো ফুটপাথের মুচি’। একই প্রসঙ্গে আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত মন্তব্যটিও করেছিলেন— ‘গড ডাজেন্ট প্লে ডাইস’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’। উল্লেখ্য, তিনি আমৃত্যু এই অনিশ্চয়তার বিরোধিতা করেছেন। কারণটা আমরা পরে জানতে পারব।</p> <p>মূল লেখা: থার্টি সেকেন্ড কোয়ান্টাম থিওরি</p>