<p>বসন্ত আসে নগরিতে, বাতাবি লেবু, জারুল, ছাতিম আর আমের মুকুলের সুবাসে ভরে ওঠে বাতাস। বসন্তের রাজধানীর ইট-পাথর ঘেরা পরিবেশে রমনা-সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যান যেন এক টুকুরো স্বর্গ। ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, পাখির কলতান, ভ্রমরের গুঞ্জন তারই মাঝে প্রাণের মেলা। বছর দশেক ধরেই অমর একুশে বইমেলা জমছে সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে। শত শত স্টল, লোকজনের জমাট ভিড়, ভেঁপু বাজিয়ে শিশুদের উল্লাস। স্টলে থরে থরে সাজানো বই। ফুলের সুবাসের সাথে নতুন বইয়ের গন্ধ একাকার হয়ে অন্যরকম অনুভতির জন্ম দেয় মনে।</p> <p>বইমেলার ধারণাটা খুব বেশি পুরোনো নয়। তবে বইয়ের ইতিহাস বহু পুরোনো। সেই মিশরীয় সভ্যাতার যুগে। সেখানে প্যাপিরাস নামে একধরনের গাছ জন্মাত। প্যাপিরাসের বাঁকল ছেঁচে কাগজের মতো একটা জিনিস তৈরি করত মিশরীয়রা। হিয়োরোগ্লিফিক্স চিত্র লিপিতে লিখে রাখত সেকালের ইতিহাস। মিশরের বিখ্যাত পিরামিড আর কবরস্থানগুলো থেকে উদ্ধার করা হয়েছে শত শত প্যাপিরাসের স্ক্রল। সেগুলোই আসলে মানব সভ্যতার প্রথম বই ছিল।  </p> <p>কাগজ আবিষ্কারের পর পুস্তক শিল্পে সত্যিকারের প্রাণ আসে। সে গল্পও কিন্তু আজকালের নয়। খ্রীষ্টের জন্মের ২০০ বছর আগে চীনারা কাগজ আবিষ্কার করে। কিন্তু সে খবর জানত না বাইরের পৃথিবী। ১৫ শ বছর আগে আরবের একদল ব্যবসায়ী চীন থেকে কাগজ ছড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বে। এরপরই বদলে যায় লেখালেখির গল্প। প্রথম দিকে হাতে লিখে বই বানানো হতো। পরে ছাপা বইয়ের উদ্ভব। সেটাও চীনদেশে। নবম খ্রীষ্টাব্দে। কাঠ খোদাই করে অক্ষর তৈরি করা হতো। সেই অক্ষরের ওপর কালি ছাপ দিয়ে লেখা হতো বইটি। লম্বায় ছয় ফুট আর এক ফুট প্রস্থের সেই বইটির নাম ছিল ‘হীরক সূত্র’। বৌদ্ধদের ধর্মীয় গ্রন্থ। বইটিতে পৃষ্ঠা ছিল মাত্র দুটি। কাঠ খোদাই করে তৈরি করা অক্ষররকে বলে ব্লক লেটার। বহুবছর পর্যন্ত ছাপাখানায় এই ব্লক লেটার পদ্ধতিই ব্যবহার হত। দ্বাদশ শতাব্দীতে চীনেই শুরু ব্লক লেটারের ব্যবহার। তারপর সেটা ধীরে ধীর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। </p> <p>সত্যিকার অর্থে আধুনিক ছাপাখানার জনক জোহান গুটেনবার্গ। এই জার্মান স্বর্ণকার ব্লক লেটারে আধুনিকতা আনেন। গুটেনবার্গ ছিলেন দরিদ্র ঘরের সন্তান। লেখাপড়াও বেশি করেননি। অল্প বয়সেই জুয়েলারির দোকানে কাজ নেন। সোনা-রুপার অলঙ্কার তৈরি করতে হত গুটেনরবার্গকে। ধাতু গলিয়ে তাতে নকশা করার নানা উপায় শিখতে হয়েছিল তাঁকে। সেই কাজ করতে গিয়েই মনে আসে ধাতব অক্ষর তৈরির কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। ধাতু গলিয়ে তৈরি করে ফেলেন ব্লক লেটার। তারপর ভাবেন, এই ব্লক লেটার ছাপাখানায় ব্যবহার করলে কেমন হয়? গুটেনবার্গের সেই ভাবনাতেই বদলে যায় মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস। কাঠের বদলে দ্রুতই ধাতুর তৈরি ব্লক লেটার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। অক্ষরগুলো ধাতুর হলেও গুটেনবার্গের ছাপার যান্ত্রটি ছিল কাঠের তৈরি। ১৫ শতাব্দীতে তাঁর ছাপাখানাতেই প্রথমবারের মতো বাইবেল ছাপা হয়। বইয়ের প্রচ্ছদেও ভিন্ন মাত্রা আনেন গুটেনবার্গ। এক রংয়ের সাথে আরেক রং মিশিয়ে আবিষ্কার করেন রঙিন ছবি ছাপার পদ্ধতি। আজকে যে তোমরা রঙিন কমিকস বই পড়তে গিয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে যাও, এর জন্য কিন্তু গুটেনবার্গের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ।</p> <p>গুটেনবার্গের আবিষ্কারের পর ইউরোপের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়ে ছাপাখানা।  আমরাও বিখ্যাত সব বই পেয়েছি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপজুড়ে বাজছে যুদ্ধের দামামা। বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী জোহান কেপলার তাঁর বিখ্যাত বই ‘রুদলফিন টেবিল’ ছাপানোর জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন জার্মানিরে এ শহর থেকে সে শহরে। সব জায়গায় মারকাটারি সেনাদের উৎপাৎ। অবশেষে উলম নামের ছোট্ট এক শহরে ছাপা হয় প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বইটি। </p> <p>আমাদের উপমহাদেশ তথা বাংলায় ছাপাখানার ইতিহাস শুরু হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। শিগগির কালের কণ্ঠে এ বিষয়ে বিস্তারিত আসছে।</p> <p>সূত্র: ব্রিটানিকা<br />  </p>