<p>শীতকালে কার্পাস তুলাকে ঘিরে আমাদের গ্রাম যেন উৎসবে মেতে উঠত। গরিব চাষিরা বাঁচত হাঁপ ছেড়ে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা অনেকটাই প্রশমিত করে দিত তুলা নামের এই ফসল।</p> <p>রাস্তার মোড়ে মোড়ে, স্কুল মাঠে, অশ্বত্থ গাছের তলে পাটি বিছিয়ে দাড়ি পাল্লা নিয়ে বসে যেত খুচরো ব্যাপারীরা। গাঁয়ের বৌয়েরা-মেয়েরা, ছেলেরা-বুড়োরা এক পোয়া, আধাসের, কিংবা এক কেজি-দুকেজি করে তুলা বিক্রি করত সেই খুচরো ব্যাপারীদের কাছে। তারপর সন্ধ্যা হলে খুচরো ব্যাপারীরা সেই তুলা বেচত বাজারে বড় বড় আড়তে। গৃহস্থ চাষীর তুলাও জমা হত আড়ৎদারদের আড়তে। সাত-সকালে সেই তুলা তারা শুকাতে দিত স্কুলের প্রশস্ত মাঠে। স্কুলে পা দেয়ার সময় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিত বকের মতো সাদা সেই তুলার দঙ্গল।</p> <p>কার্পাস তুলা ছিল আক্ষরিক অর্থেই আমাদের এলাকার সাদা-সোনা। গরিব ও দুস্থ মানুষের কর্মসংস্থানের বিরাট একটা সুযোগ তৈরি করেছিল কার্পাস তুলা। বিশেষ করে দুস্থ মহিলাদের। শীতকালে তুলা তুলে বেশ আয় হত তাদের। সাদা-সোনা বললাম কেন সেটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। নব্বই দশকের শুরুর দিকে এক কেজি চালের দাম যেখানে ৬-৭ টাকা, চিনি ৮-১০ টাকা, আলু ২-৪ টাকা, ভোজ্য তেল ২০-২৫ টাকা--সেখানে এক কেজি তুলো ২৫-৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রিকে কী বলবেন!</p> <figure class="image"><img alt="পূর্ণাঙ্গ কার্পাস তুলার গাছ" height="800" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/03/10/my1182/16155059585_7c133730c6_c.jpg" width="600" /> <figcaption>পূর্ণাঙ্গ কার্পাস তুলার গাছ। ছবি : লেখক</figcaption> </figure> <p>সাধারণত দোয়াশ ও বেলে দোয়াশ মাটিতে কার্পাস তুলা ভাল জন্মায়। বাংলাদেশের যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো তুলা চাষের সবচেয়ে উপযোগী। তুলা গাছ মোটেই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। ছায়াযুক্ত স্থানেও ভাল হয় না। তাই খোলামেলা উঁচু জমিতে চাষ করা হয়। তুলা বর্ষজীবি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। বর্ষার শেষের দিকে তুলার জীব বোপন করা হয়। লাইন করে।<br /> কার্পাস তুলা গাছ ৪-৫ ফুট লম্বা হয়। কাণ্ড বাদামি-সবুজ। ১.৫-২.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত মোটা হয়। কাণ্ডের আধফুট ওপর থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়। কাণ্ড শক্ত, সোজা। ঘন ডালপালায় কারণে ঝোপের মত ভাব দেখা যায়।</p> <p>শুকনো গাছ ভালো জ্বালনী। বিঘা দুয়েক জমির তুলা গাছ ৫-৬ সদস্যের গৃহস্থ পরিবারের সারা বছরের জ্বালানী চাহিদা মেটাতে পারে।<br /> কার্পাস তুলার পাতা দেখতে অনেকটা হাতের পাঞ্জাকৃতির। চারটি পত্র ফলক থাকে। পাতা গাঢ় সবুজ রঙের। পাতলা। বোঁটা ৩-৫ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়।</p> <p>কার্পাস তুলার ফুল দেখতে অনেকটা ঢেঁড়শের ফুলের মত। মাইক আকৃতির। পাতলা পাঁচাটা পাপড়ি থাকে। পাপড়ি ঘি ও গোলাপি রঙের। কার্পাস তুলার ফুলের পর্যায় তিনটি। কুড়ি থেকে মুখ বের করে পেঁচানো শাড়ির মতে পরস্পরের সাথে পাপড়িগুলো জড়িয়ে থাকে দু-তিন দিন। এসময় পাপড়ির রং সাদা। তারপর ফুল হয়ে ফুটে থাকে ১-২ দিন। পূর্ণ ফোটা ফুল ঘি রঙের। এরপর পাপড়িগুলো বুজে যায়। জড়িয়ে থাকে ১-২ দিন। এসময় পাপড়ির রং গাঢ় গোলাপি। তারপর ফুল শুকিয়ে বাদামী রং ধারণ করে ঝরে যায়। কার্তিক মাসের শেষ থেকে ফাল্গুন মাসের শেষ পর্যন্ত কার্পাস তুলার গাছে অনবরত ফুল, ফল আসে।</p> <p>কার্পাস তুলার ফল গাছের তুলনায় বেশ বড়। শিমুল তুলার মত লম্বাটে নয়, ডিম্বাকৃতির। গাঢ় সবুজ রঙের। পাকা ফলের রং বাদামি।<br /> ফলের ভেতর শিমুল ফলের মতই চারটা চেম্বার থাকে। চেম্বারের ভেতরে থাকে বকের মত সাদা ধবধবে আঁশ বা তুলো। কার্পাস তুলার আঁশের ভেতরে শক্তভাবে গাঁথা থাকে বীজ। বীজ শিমুল বীজের তুলনায় বেশ বড়, কিন্তু সংখ্যায় অনেক কম। বীজ বেশ ভারী, বীজসহ একমন তুলা আঁশ ছাড়িয়ে আলাদা করার পর আঁশের ওজন দাঁড়াবে মাত্র ১০ কেজি আর বীজের ওজন ৩০ কেজিতে।</p> <p>বীজ থেকে উন্নতমানের পুষ্টিকর ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। বীজ দ্বিবীজপত্রি।</p> <p>কার্পাস তুলার আঁশ বেশ স্থিতিস্থাপক। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে না। আঁশ থেকে বীজ ছড়াতে রীতিমত কসরৎ করতে হয়। মূলত জিনিং মেশিনের সাহায্যে আঁশ ছাড়ানো হয়।</p> <p>মূলত সুতা তৈরির কাজে লাগে কার্পাস তুলা। ডিপেন্সারিতে যেসব তুলা কিনতে পাওয়া যায় তা এই কার্পাস তুলা। কার্পাস তুলা দিয়ে তৈরি লেপ, তোষক, বালিশ অত্যন্ত উন্নতমানের।</p> <p>কুষ্টিয়ার মোহিনি মিল নামের বিখ্যাত স্পিনিং মিলটি ইংরেজরা স্থাপন করে। একে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে তুলা চাষের বিপ্লব শুরু হয়। পরবর্তীতে মিলটি বন্ধ হয়ে যায়। বিখ্যাত এই মিলের ধ্বংসাবশেষ রয়ে গেছে কুষ্টিয়ায়। পরিণত হয়েছে দর্শনীয় স্থানে।</p> <p>মোহিনি মিল বন্ধ হওয়ার আগে একে এবং তুলা চাষকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ায় ব্যক্তি-মালিকানায় স্থাপিত হয় কয়েকশো জিনিং মিল। মোহিনি মিল বন্ধ হলেও এসব জিনিং মিল মালিকরা তাদের আঁশ ছড়ানো ব্যবসা ধরে রাখেন। তুলোর বীজ থেকে আঁশ ছাড়িয়ে তারা সেই তুলো গার্মেণ্টস মালিকদের কাছে বিক্রি করতেন। একারণে কার্পাস তুলা চাষের রমরমা অবস্থা বজায় থাকে বিংশ শতাব্দীর শেষ বছর পর্যন্তও। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারেনি কার্পাস তুলা। ২০০০ সালের পর থেকেই দ্রবমূল্যের উর্ধগতি ছুটছে পাগলা ঘোড়ার বেগে। তার সাথে তাল মেলাতে পারেনি কার্পাস তুলা। ১৯৯২-৯৩ সালেও যেখানে বীজসহ তুলার কেজি ছিল ২৫-৩০ টাকা। ২০২৩-২৪ সালে সেখানে ৮০-১০০ টাকা।</p> <p>সঙ্গত কারণেই ধুঁকছে তুলা চাষ। চাষীরা বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে ফুল চাষকে। তাই দক্ষিণ-পশ্চিমে অঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে এক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফসলটি।</p> <p>র্কাপাস তুলার বৈজ্ঞানকি নাম: Gossypium arboreum.</p>