<p>লর্ড কার্জন একবার এক বক্তৃতায় চায়ের সপক্ষে কিছু কথা বলেন। ব্যস, আর যাবে কোথায়! আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তত দিনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ নিয়েছেন। তিনি ভাবলেন, ইংরেজদের এটা নয়া চাল। চা খাইয়ে বাঙালির আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে চায় ওরা। প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিজ্ঞানী মানুষ, তার ওপর রাসায়নিক। সুতরাং চায়ের দোষ-গুণের কথা তাঁর ভালোই জানা। তিনি একের পর এক চায়ের অপকারিতার কথা লিখে পত্রিকায় প্রবন্ধ ছাপলেন। ইংরেজরা দেখল, ভারী মুশকিল! এখনই যদি কিছু একটা করা না যায়, তবে ভারতে তাঁদের চায়ের ব্যবসা একা প্রফুল্লচন্দ্রই লাটে তুলে দেবেন। তাঁরা একজন বিজ্ঞানীকে বাগালেন। বিখ্যাত পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার ছবিসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন ইংরেজ চায়ের মালিকেরা। সেখানে মেঘনাদের মুখ থেকে তাঁরা বলিয়ে নিলেন, ‘আমি প্রতিদিন চা পান করি, আপনারাও করুন।’ </p> <p>এই বিজ্ঞাপনই প্রমাণ করে, প্রফুল্লচন্দ্র ইংরেজদের চা ব্যবসার ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন। আসলে প্রফুল্লচন্দ্র রায় যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। </p> <p>১৮৬১ সাল বাঙালির জন্য সুবর্ণ বছর। সেই বছরইে জন্মেছিলেন বাংলার সাহিত্য ও বিজ্ঞানজগতের দুই মহান পুরুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রফুল্লের জন্ম সে বছর আগস্ট, বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা জেলার রুডুলি গ্রামে। বাবা হরিশ্চন্দ্র ছিলেন ডাকসাইটে জমিদার। কিন্তু বিদ্যানুরাগী। ফারসি ভাষার একজন পণ্ডিতও বটে। আজ থেকে দেড় শ বছর আগেই তিনি তাঁর গাঁয়ে দু-দুখানা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই স্কুলেই প্রফুল্লচন্দ্রের লেখাপড়ার হাতেখড়ি।<br /> নয় বছর বয়সে হরিশ্চন্দ্র ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন। ভর্তি করিয়ে দিলেন বিখ্যাত হেয়ার স্কুলে। চতুর্থ শ্রেণিতে। কিন্তু ছোটবেলায় প্রফুল্লচন্দ্র আর দশটা সাধারণ ছেলের মতো সুস্থ-সবল ছিলেন না। প্রায়ই রোগে ভুগতেন। একসময় স্বাস্থ্য এতটাই ভেঙে পড়ল, পরীক্ষা দিতে পারলেন না। স্কুল ছাড়তে হলো প্রফুল্লচন্দ্রকে। ফিরে গেলেন গ্রামে। দুই বছর সেখানেই কাটল। কিন্তু লেখাপড়া থেকে দূরে থাকলেন না। বাবা বিদ্যানুরাগী মানুষ। বাড়িতে লাইব্রেরিও আছে। নানা রকম বইয়ে ঠাসা সেই লাইব্রেরি। সেখানে বসে বই পড়ে সময় কাটতে লাগল প্রফুল্লচন্দ্রের।</p> <p>দুই বছর পর আবার কলকাতায় পাঠানো হলো প্রফুল্লচন্দ্রকে। কলকাতায় তখন কেশবচন্দ্র সেন একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। নাম আলবার্ট স্কুল। কেশবচন্দ্র ছিলেন আপদমস্তক সমাজসেবী। তাঁর সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্রের বাবা হরিশ্চন্দ্রের ভাব। প্রফুল্লকে তাই আলবার্ট স্কুলেই ভর্তি করানো হলো। সেখান থেকেই এন্ট্রান্স অর্থাৎ আজকালকার এসএসসি পাস করলেন প্রফুল্লচন্দ্র। এরপর গিয়ে পড়লেন সোজা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জিম্মায়। বিদ্যাসাগর হরিশ্চন্দ্রের বন্ধু। বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠা করা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সেখান থেকেই এফএ, অর্থাৎ এখনকার উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়।</p> <p>প্রফুল্লচন্দ্রের ইচ্ছা ছিল বিলেত গিয়ে পড়বেন। তাঁর বাবারও সেই ইচ্ছা। কিন্তু তত দিনে হরিশ্চন্দ্রের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। অগত্যা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ ভর্তি হলেন। কিন্তু বুকের ভেতরের স্বপ্নটা মরতে দেননি। বিলেতে ফ্রি পড়াতে যাওয়ার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল। তার জন্য পরীক্ষা দিতে হতো।</p> <p>প্রফুল্লচন্দ্র সেই পরীক্ষায় ভালোভাবেই উতরে গেলেন। বিএ কোর্স শেষ করার আগেই তাই গিলক্রাইস্ট বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়। খুব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকেই ১৮৮৫ সালে অর্জন করলেন বিএসসি ডিগ্রি। মৌলিক গবেষণার জন্য অর্জন করলেন ডক্টর অব সায়েন্স, অর্থাৎ ডিএসসি ডিগ্রি ১৮৮৭-তে।</p> <p>প্রফুল্ল যখন ছাত্র, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন রসায়ন বিজ্ঞানের একটা সোসাইটি গঠন করা হলো। সেই সোসাইটির সহসভাপতি নির্বাচিত হলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আর সভাপতি হলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ক্যাম ব্রাউন। সে সময় একটা রচনা প্রতিযোগিতা করা হয় এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাসভিত্তিক। বিষয় ছিল ‘সিপাহি বিদ্রোহের আগে ও পরের ভারত’। অনেক খেটেখুটে একটা লেখা দাঁড় করালেন প্রফুল্লচন্দ্র। সবার প্রশংসা কুড়ায় সেই লেখা। হয়তো সেদিনই প্রফুল্লচন্দ্রের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল ইতিহাসনির্ভর বিজ্ঞান লেখালেখির বিষয়টা। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দুহাত ভরিয়ে দিয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ই তাঁকে হোপ পুরস্কার প্রদান করে। </p> <p>১৮৮৮-তে কলকাতায় ফিরে এলেন প্রফুল্লচন্দ্র। শিক্ষকতা করতে চান। কিন্তু প্রথমেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরকার। তখন ইন্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিসের অধীনে শিক্ষকতা করছেন দেশবরেণ্য সব শিক্ষাবিদেরা। প্রফুল্লচন্দ্রেরও সেই ইচ্ছা। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ পেলেন না। বলা হলো, বেঙ্গল এডুকেশনাল সার্ভিসের অধীনে শিক্ষকতা করতে। তা-ই করলেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন। তখন সেই কলেজের অধ্যাপক আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, তিনি আবার প্রফুল্লচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জগদীশচন্দ্র তখন উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁর সহকারী হয়ে প্রফুল্লও যোগ দিলেন সেই গবেষণায়। </p> <p>একসময় নিজে নিজেই গবেষণা শুরু করেন। পাশাপশি অধ্যাপনা। ১৮৯৬ সাল। রসায়নবিজ্ঞানের এক আশ্চর্য বছর। কারণ, সে বছরই প্রফুল্লচন্দ্র আবিষ্কার করলেন প্রায় অসম্ভব এক যৌগ মারকিউরাস নাইট্রাইট। অসম্ভবই বটে। তাঁর এই আবিষ্কার নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। বিশ্বখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’-এ ছাপা হলো তাঁর প্রশংসাবাণী। এ তো কম পাওয়া নয়!</p> <p>তাঁর এই আবিষ্কারটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? </p> <p>কারণ, মারকিউরাস হলো পারদের এক বিশেষ অবস্থা। এই অবস্থা খুব অস্থায়ী। অন্যদিকে নাইট্রোজেন আর হাইড্রোজেনের এক বিশেষ বন্ধনের নাম নাইট্রাইট। এই বন্ধনও খুব অস্থায়ী। দুই অস্থায়ী মিলেমিশে মারকিউরাস অক্সাইড তৈরি করছে, সেটা আবার খুব স্থায়ী। কীভাবে এটা সম্ভব—এই প্রশ্নই অনেকের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সেটা যেমন সে যুগে, সেটা এ যুগেও সত্যি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে প্রফুল্লচন্দ্রের দেড় শততম জন্মদিনেই সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলেন, বহু চেষ্টা করেও তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট তৈরি করতে পারেননি। তাঁর মতে, মারকিউরাস নাইট্রাইটের কোনো অস্তিত্বই নেই। অর্থাৎ প্রফুল্লচন্দ্রের আবিষ্কার হয় ভুল ছিল, নয়তো তিনি মিথ্যা বলেছিলেন। সে বছরই সুভাষ সামন্ত, শ্রীবত গোস্বামী ও অনিমেষ চক্রবর্তী আরেকটা গবেষণাপত্র লিখে প্রমাণ করেছেন মারকিউরাস নাইট্রাইটের অস্তিত্ব।</p> <p>মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কার খুলে দেয় লবণ আবিষ্কারের নতুন দুয়ার। প্রফুল্লচন্দ্র একের পর এক নাইট্রাইট আবিষ্কার করেছেন। বিশ্বব্যাপী তাঁর কাজের মূল্যায়ন হয়েছে। একসময় বিশ্ববিজ্ঞানীরা তাঁকে নতুন এক নামে ডাকতে শুরু করেন—মাস্টার অব নাইট্রাইটস।</p> <p>ব্যক্তিজীবনের চেয়ে দেশের ভালোটাই ছিল প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছে সবচেয়ে বড়। তিনিই উপমহাদেশে প্রথম রাসায়নিক ও ওষুধ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। নাম বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিউক্যাল লিমিটেড। এ দেশের মানুষের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য তাঁকে পীড়া দিত। দেশের মানুষের কর্মসংস্থান ও দেশীয় পণ্য উৎপাদনে উৎসাহী করতে তিনি একে একে গড়ে তুলেছেন বেঙ্গল পটারি, বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস, ক্যালকাটা সোপ, ন্যাশনাল ট্যানারিজের মতো শিল্প প্রতিষ্ঠান। লিখেছেন দেড় শটির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ। লিখেছেন ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে গোটা তিরিশেক বিজ্ঞানবিষয়ক বই। তাঁর সেরা কাজ উপমহাদেশের রসায়নচর্চার ইতিহাস—হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস। </p> <p>তিনি মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহী করেছেন তরুণদের। নিজে কখনো বিলাসিতার ধার ধারেননি। একটা বাড়ি পর্যন্ত ছিল না। প্রেসিডেন্সি কলেজের একটা ঘরে সারাটা জীবন কাটিয়েছেন। খুব সাদামাটা পোশাক পরতেন। তাঁর কাছে হাত পেতে কোনো গরিব-দুঃখী খালি হাতে ফেরেনি। অবসরের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যা কিছু পাওনা ছিল, সব বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন।</p> <p>১৯৪৪ সালের ১৬ জুন এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে।<br />  </p>