<p style="text-align:justify">দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ জেলা ভোলায় উত্তোলনযোগ্য আরও ৫ দশমিক ১০৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন  (পেট্রোবাংলা) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির (বাপেক্সে) সঙ্গে যৌথ চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গ্যাজপ্রম চার বছর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে এই মজুত গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু উচ্চ মূল্যে দেশের বাইরে থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করার জন্য এবং এলএনজি আমদানিকারক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু দেশবাসীর কাছ থেকে এই সুখবর চেপে যান। </p> <p style="text-align:justify">গত জুন মাসে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে গবেষক দলসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে জানাতে চাইলেও নসরুল হামিদ তার স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের সংবাদ সম্মেলন করতে বাধা দেন বলে গবেষক দলের সঙ্গে জড়িতরা নিশ্চিত করেছেন। </p> <p style="text-align:justify">পেট্রোবাংলা ,বাপেক্স ও গ্যাজপ্রমের গবেষণাটি ২০২০ সালে শুরু হয়ে চলতি বছরের জুনে শেষ হয়। সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সে জমা দেওয়া হয়েছে। </p> <p style="text-align:justify">সংশ্লিষ্টরা জানান, এক টিসিএফ গ্যাস দিয়ে দেশের এক বছরের গ্যাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভোলার শাহবাজপুর ও ইলিশায় ২.৪২৩ টিসিএফ এবং চর ফ্যাশনে ২.৬৮৬ টিসিএফ মজুত গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। উত্তোলনযোগ্য ৫ দশমিক ১০৯ টিসিএফ গ্যাস স্পট মার্কেট এলএনজির দর হিসেবে (১০.৪৬ মার্কিন ডলার প্রতি এমএমবিটিইউ) প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ভোলার এই কূপগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হলে দৈনিক ৯২০ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা যাবে। </p> <p style="text-align:justify">এতে একদিকে দেশের গ্যাস সংকট দূর হবে, অন্যদিকে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি নির্ভরতাও কমবে। এই গ্যাস দিয়ে ৬০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ভোলার শাহবাজপুর থেকে ইলিশা পর্যন্ত ৬০০ বর্গ কিলোমিটার থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করা হয়েছে। এতে ২ দশমিক ৪২৩ টিসিএফ উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত আবিষ্কৃত হয়েছে। ভোলার চরফ্যাশনে ১৫২.৬ লাইন কিলোমিটার টুডি সিসমিক সার্ভে করে ২ দশমিক ৬৮৬ টিসিএফ গ্যাসের মজুত পাওয়া গেছে। </p> <p style="text-align:justify">গ্যাজপ্রমের মুখপাত্র এলক্সি বেলবেজিয়াভ জানান, ‘এই গবেষণাটি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা করা হয়েছে। যেখানে সিসমিক ডাটা, অয়েল লক ডাটা, কোর ডাটা বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার, সুপার কম্পিউটার সিস্টেম এবং উন্নতমানের ল্যাব ব্যবহার করার ফলে গবেষণার তথ্যগুলো খুবই নির্ভরযোগ্য। যার উপর ভিত্তি করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা অনেকাংশ্যই পূরণ হবে। </p> <p style="text-align:justify">এ বিষয়ে গ্যাজপ্রমের একজন গবেষক বলেন,  চলতি বছরের জুনে এই তথ্য যখন আমাদের হাতে আসে তখন এই বিষয়ে আমরা সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী সে সময় আমাদের এমনটি করতে মানা করেন। কারণ দেশে এত গ্যাস পাওয়া গেলে বাইরে থেকে বেশি দাম দিয়ে এলএনজি আমদানি করা যাবে না। আমাদের কাছে প্রথম এ বিষয়ে প্রতিবেদন আসে জানুয়ারিতে। এরপর এটি ভালোভাবে ফাইনাল এনালাইসিস করে জুনে প্রতিবেদনটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। তখন আমরা এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করে সুখবরটি মানুষকে জানাতে  চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন নসরুল হামিদ আমাদের বাধা দেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে সে সময় আমাদের বিষয়টি না জানানোর জন্য বলা হয়। আমরা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টার কাছে আমাদের প্রাপ্ত ফলাফলের প্রেজেনটেশন উপস্থাপন করতে চাচ্ছি। </p> <p style="text-align:justify">গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বর্তমানে ভোলায় পাঁচটি কূপ দিয়ে দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। আরও চারটি কূপ খনন করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকেও দৈনিক আরও ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। আরও পাঁচটি কূপের প্রস্তাবনা দেওয়া আছে, সেখান থেকেও আগামী দুই বছরের মধ্যে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। এ ছাড়াও আরও ১৪টি কূপের স্থান শনাক্ত করা হয়েছে। সেখান থেকেও আরও ২১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। চর ফ্যাশনে ছয়টি জিওলজিক্যাল ভূত্বাত্তিক কাঠামো শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে ৩০টি কূপ খনন করা যেতে পারে। এ কূপগুলো থেকে দৈনিক ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। </p> <p style="text-align:justify">পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২ হাজার ৬৩৩ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি থাকছে ১৩৬৭ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। স্বাভাবিক সময়ে দুটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি রূপান্তরের মাধ্যমে ১০৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হতো। কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে সামিটের একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কম হচ্ছে। এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকন্দ্র ও শিল্প-কারখানাসহ সব খাতেই গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। </p> <p style="text-align:justify">জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম গতকাল বলেন, ভোলা এবং তার আশপাশে যে অঞ্চল আছে তা গ্যাসের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়। ভোলা দ্বীপে এরই মধ্যে তিনটি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করা হয়েছে। এর একটি শাহবাজপুর, ভোলা নর্থ একটি এবং আরও উত্তরে আছে ইলিশা। এই দ্বীপে আরও গ্যাসের মজুত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই দ্বীপটি খুবই গ্যাসসমৃদ্ধ একটি দ্বীপ। </p> <p style="text-align:justify">পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ভোলায় আমরা বিভিন্ন টুডি এবং থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করেছি। ভবিষ্যতে আরও করব। কিন্তু নির্দিষ্ট করে ঠিক কী পরিমাণ গ্যাস পাওয়া গেছে তা সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ না করে বলা যাবে না। এই এলাকা গ্যাসের জন্য বেশ সম্ভবনাময়। এজন্য সাড়ে  ৪ হাজার কিলোমিটার  টুডি সিসমিক সার্ভে করতে চাচ্ছি। এরপর থ্রিডি করতে চাচ্ছি। এগুলো করলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে সেখানে ঠিক কী পরিমাণ গ্যাস আছে। আমাদের প্রত্যাশা এই এলাকায় প্রচুর গ্যাস আছে। তবে বিশেষ আইনের আওতায় যে প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে সেগুলো যাচাই বাছাইয়ের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। সেখানে গ্যাজপ্রমের কূপ খননের কাজগুলোও যাচাই করা হবে। সেক্ষেত্রে কমিটি যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। আমরা এক্ষেত্রে ওপেন টেন্ডারের চলে যাব। আমাদের দেশীয় উৎস থেকে দ্রুত গ্যাস আনতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরা উন্মুক্ত টেন্ডারের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত আছি। </p> <p style="text-align:justify">পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, ভোলায় গত তিন দশক আগে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক মুনাফাযোগ্যতা নিয়ে সংশয় থেকে এসব ক্ষেত্রের গ্যাস মূল ভূখণ্ডে সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নির্মাণ করা যায়নি। এখন ভোলায় গ্যাসের রিজার্ভ বাড়ায় পাইপলাইন করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা সামনে এসেছে। বর্তমানে ভোলার গ্যাস স্বল্প পরিসরে স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ছোট ছোট কারখানায় সরবরাহ করা হচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সূত্র: </strong>বাংলাদেশ প্রতিদিন</p>