<p style="text-align:justify">সড়ক ও বাজারগুলোতে চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ করা গেলে মাছ ও শাক-সবজির মতো নিত্যপণ্যের দাম কমপক্ষে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়্যারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) গবেষণায় এমন তথ্য মিলেছে। যদিও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ করা গেলে শাক-সবজির দাম ৩০ শতাংশের বেশি কমতে পারে।</p> <p style="text-align:justify">নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ চাঁদাবাজি। উৎপাদনস্থল থেকে শুরু করে বাজারে পৌঁছানো পর্যন্ত পথে দফায় দফায় চাঁদা দিতে হয়। এমনকি চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য পাইকারি ও খুচরা বাজারেও। তবে বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে চাঁদাবাজির উৎপাত কিছুটা কমে এসেছে। এর পরও কোথাও কোথাও নতুন করে চাঁদাবাজরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও মাঠে থাকা শিক্ষার্থীরা ব্যবসায়ীদের সহায়তায় তা প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন।</p> <p style="text-align:justify">এর প্রভাবে বাজারে কমতে শুরু করেছে মুরগি, মাছ, শাক-সবজিসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম। এখন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বেগুন, পটোল, ঢেঁড়স, ঝিঙা, করলা, চিচিঙ্গাসহ বেশির ভাগ সবজিই ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে ক্রেতারা কিনতে পারছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবজিসহ মাছ, ডিম ও মুরগি উৎপাদনস্থল থেকে রাজধানীর বাজারে আসতে বেশ কয়েকবার চাঁদা দিতে হতো। এসব চাঁদা নিতেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্য এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।</p> <p style="text-align:justify">বেশ কয়েক দিন ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া চাঁদাবাজমুক্ত করতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই কাঁচাবাজারগুলো নিয়মিত মনিটর করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। ফলে সড়কে চাঁদাবাজি, পুলিশের হয়রানি কমেছে। এতে পণ্য পরিবহনে ভাড়াও আগের তুলনায় কিছুটা কমে গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।</p> <p style="text-align:justify">বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে সবজিবোঝাই ট্রাক নিয়ে নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত করেন বগুড়া শহরের সুলতানগঞ্জপাড়ার জনি শেখ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে যেমন পুলিশের নামে, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে সড়কে চাঁদা নেওয়া হতো, এখন তা পুরোপুরি বন্ধ। এ কারণে আগের তুলনায় ট্রাকভাড়াও কমে গেছে।’</p> <p style="text-align:justify">রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার। সেখানকার সবজি সরবরাহকারী এক পাইকারি বিক্রেতার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সড়কে পুলিশের এবং বাজারে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের খরচ বেড়ে যেত। এই বাড়তি খরচ পণ্যের ওপর পড়ত। এখন সড়কে পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ হলেও বাজারে চাঁদাবাজি পুরোপুুরি বন্ধ হয়নি। আগের তুলনায় চাঁদাবাজি অনেকটাই কমে যাওয়ায় আমাদের পরিবহন ব্যয়ও কিছুটা কমে গেছে।’ </p> <p style="text-align:justify">জানতে চাইলে ভোক্তার নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাস্তায় চাঁদাবাজির জন্য বিশেষ করে কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকায় কাঁচামাল আনার সময় নানা জায়গায় চাঁদাবাজি হয়। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এসব চাঁদা নেন। মূলত ট্রান্সপোর্ট সেক্টরের চাঁদাবাজির বিষয়টি ভয়াবহ, এটি শুধু একটি পয়েন্টে চাঁদা দিলেই হয় না, বিভিন্ন জায়গায় দিতে হয়। এ ছাড়া বাজারভিত্তিক চাঁদাবাজিও হয়। প্রতিটি পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিশেষ ধরনের চাঁদাবাজ গোষ্ঠী রয়েছে। সব চাঁদাবাজিকে যখন আমরা একত্র করি, তখন দেখা যায় মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়ে যায় ওই পণ্যের ওপর।’</p> <p style="text-align:justify">খলিলুর রহমান সজল বলেন, ‘এসব চাঁদাবাজির কারণে কাঁচামালের দাম কত শতাংশ বেড়ে যায় এই বিষয়ে আমাদের সংগঠন থেকে একটি গবেষণা করেছি। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, নানা ধরনের চাঁদাবাজির জন্যই কাঁচামালের ব্যয় কমপক্ষে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আসলেই কি চাঁদাবাজি কমেছে, কি কমেনি—এ বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য এখনো যথেষ্ট সময় হয়নি। আগে দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চাঁদাবাজি করা হতো। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের লোকজন চাঁদাবাজিটা চালিয়ে যেত। পাইকারি বাজার থেকে কাঁচামাল কিনে ভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে যাঁরা পণ্য বিক্রি করেন, তাঁদেরও বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত লোকদের চাঁদা দিতে হতো।’</p> <p style="text-align:justify">ভোক্তার নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এখন আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই দিকে খেয়াল রাখবে। রাস্তাঘাটের চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে এখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। আশা করছি, চাঁদাবাজিও কমে আসবে এবং ভোক্তারাও অন্যান্য সময়ের তুলনায় আগামী দিনে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কমে পণ্য কিনতে পারবে।’ </p> <p style="text-align:justify">মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ‘অনেক লেভেলে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। সরবরাহের ক্ষেত্রে যেখানে উৎপন্ন হচ্ছে, সেখান থেকে বাজার পর্যন্ত আসতে অনেক জায়গায় চাঁদা দিতে হয়, যেটা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। একটা মন্ত্রণালয় একা কাজ করতে পারবে না। এটা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় সবাই মিলে করতে হবে। এসব বিশেষ খাদ্যের দাম বাড়তে দেওয়া যাবে না। আমি আরো আলোচনা করব কোথায় কোথায় সমস্যা আছে এবং সেখানে গিয়ে অবশ্যই দাম কমাতে চাই।’</p> <p style="text-align:justify">বগুড়া : একদিকে হাটের টোল নেই, অন্যদিকে কমিশনভোগীরাও লাপাত্তা—এ কারণে বগুড়ার কাঁচাবাজারে সবজির দাম কমেছে। একইভাবে পথে পথে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কাঁচামাল সরবরাহে পণ্যবাহী ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানের ভাড়াও কমেছে অনেকটাই। ফলে স্বল্প খরচে শাক-সবজি যাচ্ছে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায়।</p> <p style="text-align:justify">মহাস্থানহাটের ব্যবসায়ী মা সফুরা ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী শাহাদৎ হোসেন, বিশাল ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী পুটু মিয়া এবং শাহ সুলতান সবজি ভাণ্ডারের মালিক বাবুল মিয়া বাবু জানান, গত দুই সপ্তাহের তুলনায় হাটে সবজির আমদানি কম। কিন্তু এতে বাজারে মূল্যবৃদ্ধি না পেয়ে বরং আগের চেয়ে দাম অনেক কমে গেছে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বাজারে সবজি নিয়ে এলেই আগে টোল দিতে হতো। অনেক সময় জায়গার জন্য ভাড়া দিতে হতো। এ ছাড়া ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে চুক্তি করে বেশি দামে তা আড়ত এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করত। এখন সেসবের কিছু নেই। কৃষক সরাসরি তাঁর পণ্য এনে হাটে বিক্রি করছেন। যা দাম তা সরাসরি কৃষক পাচ্ছেন, ফলে পণ্যের সংকটের অজুহাতে দাম বাড়ছে না।</p> <p style="text-align:justify">বাজারের এনসিডিপি আড়তদার আয়নাল হক জানান, আগে যেখানে মালবাহী পিকআপে ঢাকায় সবজি পাঠাতে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লাগত, এখন সেখানে লাগছে সাত থেকে ৯ হাজার টাকা। এ ছাড়া বড় ট্রাকে আগে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগলেও এখন সেই ভাড়া ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা পড়ছে। ফলে শুধু মহাস্থানহাটেই নয়, দেশের অন্যান্য বাজারেও এর প্রভাবে সবজির দাম কমেছে।</p> <p style="text-align:justify">ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বগুড়ার সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, বাজারে সবজির আমদানি কম হলেও দাম বাড়েনি। এর কারণ হলো কয়েক ধাপে চাঁদা বন্ধ হওয়া। আগে বাজারে টোল, জায়গার ভাড়া, সড়কে পণ্যবাহী ট্রাক আটকে চাঁদা তোলার মতো ঘটনা ঘটত। এখন সেসব নেই। এই অবস্থা যেন অব্যাহত থাকে সেটি নিশ্চিত করতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাহলে সরবরাহ কম হলেও মূল্যবৃদ্ধির মতো ঘটনা ঘটবে না।</p> <p style="text-align:justify">নরসিংদী : নরসিংদীর বেলাব উপজেলার সবচেয়ে বড় পাইকারি সবজির হাট বারৈচা বাজারে কথা হয় পাইকারি সবজি ক্রেতা জায়েদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি নরসিংদীর বিভিন্ন সবজির হাট থেকে পাইকারি সবজি কিনি, পরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করি। এখন সব জায়গায়ই চাঁদা কমছে।’</p> <p style="text-align:justify">রাজধানীর শনির আখড়া থেকে আসা সবজি পরিবহনের চালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, ট্রাকে মাল ওঠালেই পুলিশ, ট্রাফিক, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, রাজনৈতিক নেতাকর্মী—এ রকম কত রকমের চাঁদার টোকেন দেওয়া হতো। পথে পথে হয়রানি তো আছেই, কেউ ভালো আচরণটা পর্যন্ত করত না।</p> <p style="text-align:justify">মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জে সবজির বাজার কিছুটা নিম্নমুখী। পরিবহনের চাঁদাবাজির প্রভাব মুন্সীগঞ্জে তেমন একটা না থাকলেও মুন্সীগঞ্জ থেকে যখন পাইকাররা সবজি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন, তখন তাঁরা পথে পথে পরিবহন চাঁদাবাজির শিকার হন। এর ফলে ঢাকার বাজারে গিয়ে প্রভাব পড়ে। এখন এসব চাঁদাবাজ গাঢাকা দিয়েছে বলে জানান পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত চালকরা। </p> <p style="text-align:justify"><strong>[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন বগুড়া, নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি]</strong></p>