<p>ইতিহাস বলে, কোনো রাজনৈতিক শক্তির জন্ম হলে তার বিকাশ হয়। বিকাশ হতে হতে একদিন সেই শক্তি একদম ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যায়। কিন্তু তারপর সেই শক্তির পতন হয়। কাজেই উত্থান এবং পতন—এই দুটিই রাজনীতির প্রাকৃতিক সত্য।</p> <p>বাংলা প্রবাদ, ‘অতি হলে ইতি’ হয়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আমরা দেখছি, ভোটের ফলাফলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির সেই অতীতের একচেটিয়া আধিপত্য থাকেনি। ২০১৪ সালে যে যাত্রাপথের শুরু, ২০১৯ সালে সেই আসনসংখ্যা বিজেপির আরো বেড়ে ৩০৩-এ পৌঁছে যায়। কিন্তু তারপর? তারপর নরেন্দ্র মোদি সংসদে উচ্চকিত কণ্ঠে ঘোষণা করলেও ‘আব কি বার ৪০০ পার’ হয়নি।</p> <p>বিজেপি ২৪০টি আসনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় আসনও নরেন্দ্র মোদির থাকেনি। কিন্তু তার পরপরই বিধানসভা উপনির্বাচন এসে গেল। সেই উপনির্বাচনেও দেখা গেল, বিজেপি গোহারা হারল।</p> <p>১৩টি আসনে নির্বাচন হলে ১০টিই তাদের হাতছাড়া হলো। প্রতিপক্ষ ইন্ডিয়া জোটের হাতে চলে গেল। হিমাচল প্রদেশের হামিরপুর আর মধ্য প্রদেশের আমারওয়ারা—এই দুটি আসন ছাড়া কার্যত সব আসনই বিজেপি হারিয়েছে। বিহারে জেডিইউ-ও হারিয়েছে বিজেপির শরিক হিসেবে তার দলের প্রার্থীকে জেতাতে। সব মিলিয়ে বিজেপির জন্য অশনিসংকেত।</p> <p>বিজেপি নেতারা এখন বলছেন, উপনির্বাচনের ফল সাধারণত শাসক দলের পক্ষে যায়। সেই কারণে মধ্য প্রদেশের একটি আসন বিজেপি রক্ষা করতে পেরেছে। সেখানেও কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জেতার ব্যবধান খুব কম। চার হাজারেরও কম ভোটে জিতেছেন বিজেপির প্রার্থী। এই পরিস্থিতিটা কেন হলো? এই পরিস্থিতি কত দিন এভাবে চলবে? এর পরও এসে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। আছে বিহারে ভোট। আছে ঝাড়খণ্ডে ভোট। আছে মহারাষ্ট্রের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজ্যের ভোট, যেখানে মুম্বাই শহর হচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। এ ছাড়া আছে হরিয়ানা। আর আছে কাশ্মীর। সব মিলিয়ে ভারতের রাজনীতিতে এখন টান টান উত্তেজনা।</p> <p>প্রশ্ন উঠেছে, কেন এমন হচ্ছে? ভোটের এই ফলে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির এই পতনের কারণ কী? এমনকি বিজেপির চালিকাশক্তি আরএসএসের মতো সংগঠনও সমালোচনা করতে শুরু করেছে। সংঘ-চালক মোহন ভাগবত নরেন্দ্র মোদির নাম না করেও বলেছেন যে কোনো ব্যক্তিনির্ভর প্রচার, ব্যক্তির অহংকার, ব্যক্তির একচেটিয়া কর্তৃত্ব কখনো গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়, দেশের জন্য ভালো নয়। এই অহংকার অনেক সময় নির্বাচনে ভরাডুবির কারণ হয়। কার্যত তিনি যা বলেছেন, তাতে রাজনৈতিক মহলের মনে হয়েছে যে এটি নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশেই তিনি বলেছেন। যদিও বিজেপি সে কথা অস্বীকার করছে। মোহন ভাগবত সম্পর্কে তাঁরা বলছেন, তিনি সাধারণভাবে সব রাজনৈতিক দলের সব রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলেছেন।</p> <p>কিন্তু মোহন ভাগবতের বক্তব্যের বিষয়টিকে যদি আমরা একটু দূরে সরিয়েও দিই, তাহলেও বলতে হবে, বিরোধীদের কার্যকলাপও অনেক বেড়ে গেছে। সংসদে এখন কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ১০০ ছুঁই ছুঁই। তার ফলে রাহুল গান্ধী বিরোধী দলনেতা হতে পেরেছেন এই প্রথম। ২০১৪ সালের পর থেকে তো কোনো নেতাই ছিল না। সংসদে বিরোধীরা এখন অনেক সোচ্চার হয়েছেন। যদিও এখনো অনেক সমন্বয়ের অভাব রয়েছে এবং রাজ্যে রাজ্যে অনেক রকমের মতপার্থক্য আছে। যেমন—পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এবং কংগ্রেসের আঁতাত আছে। তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের ঘোরতর বিরুদ্ধে। ঠিক এই একইভাবে কেরালাতে সিপিএম এবং কংগ্রেসের মধ্যেই প্রধান লড়াই। অথচ কেন্দ্রে মোদির বিরুদ্ধে তাদের একজোট হতে হচ্ছে।</p> <p>রাহুল গান্ধী উত্তর প্রদেশে জেতায় উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতেও এবার আলোড়ন পড়েছে। কেননা এর আগে আমেথিতে স্মৃতি ইরানি রাহুল গান্ধীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। এবারে স্মৃতি ইরানির বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধী প্রার্থী না হলেও কংগ্রেসের স্থানীয় প্রার্থীও জিতে গেছেন এবং স্মৃতি ইরানিকে হারিয়ে দিয়েছেন। আমেথি না হলেও উত্তর প্রদেশের অন্য আসনে, রায়বেরিলি থেকে রাহুল গান্ধী জিতেছেন। তার ফলে এখন উত্তর প্রদেশেও অখিলেশ এবং রাহুল গান্ধীর জোট আছে। সেখানে কিন্তু একটা বোঝাপড়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে পাঁচ বছর পরে যে লোকসভা নির্বাচন, সেটাতে কী হবে বলা যাচ্ছে না। আর সেটা তো এখন ঢের বাকি।</p> <p>তবে একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, যেভাবে একতরফা বিজেপির রাজনীতিটা ১০ বছর ধরে সাধারণ মানুষ দেখেছে, সেটা কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। তাহলে তার আসল কারণটা কী? বিহারে নীতিশ কুমার এবং অন্ধ্র প্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডু মুখ্যমন্ত্রী আছেন। এই দুটি দল; অর্থাৎ তেলুগু দেশম এবং জেডিইউ—তারা দুটো রাজ্যের জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য চাইছে। বাজেটে এই প্রথম নরেন্দ্র মোদিকে শরিক দলগুলোর জন্য আপস করতে হয়েছে। যার জন্য অন্য আঞ্চলিক দলগুলো তাদের রাজ্যের জন্য সোচ্চার হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক বঞ্চনার প্রতিবাদে নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিয়েও বিরোধিতা করেছেন এবং বৈঠক বয়কট করছেন।</p> <p>দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি খড়গপুরের আইআইটি থেকে পাস করা স্নাতক চাকরি পাচ্ছেন না। গতবার যতজন আইআইটি থেকে পাস করা বেকার ছিলেন, এখন সেই সংখ্যা আরো বেড়েছে। বেকারদের সংখ্যা কমেনি। সে ব্যাপারে এখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও খবর হতে শুরু করেছে। এখন কিন্তু আর্থিক ব্যাপারেও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছে।</p> <p>তৃতীয়ত, মোদি সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। কিন্তু সেই বাজেটকে সাধারণ দরিদ্র জনতার স্বার্থবিরোধী বলে সরব হয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধী দল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূলও এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে। এই বাজেটে পরিকাঠামো, গ্রামোন্নয়ন, কৃষি ইত্যাদি খাতে বরাদ্দে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তাতে রাজ্যগুলো লাভবান হবে কি হবে না, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক চলছে।</p> <p>বাজেটটা জনবিরোধী এবং বাজেটে শুধু বিহার এবং অন্ধ্র প্রদেশকে সাহায্য করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই, সেই রাজ্যগুলোর প্রতি বিমাতাসুলভ মনোভাব দেখানো হয়েছে। এই অভিযোগ দেখিয়ে বিরোধীরা আরো বেশি সরব হচ্ছে। উত্তর প্রদেশে গোহারা হেরেছে বিজেপি। হিন্দুত্বকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। অযোধ্যায় ভোটে হেরেছে বিজেপি। বেনারসে নরেন্দ্র মোদির ভোটের মার্জিন কমে গেছে। এই অবস্থায় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে সরানো হবে কি না, দলের মধ্যে সেই নিয়ে চলছে যথেষ্ট গোলমাল।</p> <p>ভারতের তিনটি সমস্যা খুব জটিল চেহারা ধারণ করেছে। একটি হলো, তীব্র বেকারত্ব। দ্বিতীয়টি হলো, খাদ্যপণ্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি। তৃতীয়টি হলো, বিপুল আর্থিক অসাম্য। এমনকি বাজেটে এই তিন ব্যাধির কোনো ওষুধ  অর্থমন্ত্রী খুঁজে পাননি। তার ফলে সেই সমস্যাগুলোকে একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছেন না। ভোট যে মানুষের সমর্থন করছে, তার জন্য আসলে কারণ হচ্ছে এই অভ্যন্তরীণ আর্থিক সমস্যা। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা নমুনা সংখ্যা হয়েছিল ৮.২৫ লাখ। পিরিওডি লেবার ফোর্স সার্ভেতে ৪.১ লাখ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার ৭৮তম রাউন্ডে নমুনার সংখ্যা ছিল ১১.৬৩ লাখ। নমুনা সমীক্ষার হিসাবে সংখ্যাগুলো যথেষ্ট বড়। কিন্তু এখন অবধি জনশুমারির কাজ শুরুই হয়নি। যে পরিসংখ্যানগুলো এক্ষুনি জানালাম, তা কোনোভাবেই ১৪০ কোটি মানুষকে নিয়ে হওয়া জনশুমারির বিকল্প হতে পারে না। তা ছাড়া করোনাকাল পেরিয়ে এসে যদি ১৩৭টি দেশ জনশুমারি সেরে নিতে পারে, তাহলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়?</p> <p>অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে মোট ৪.১ কোটি বেকারকে কাজের সুবিধা ও প্রশিক্ষণ বাবদ দুই লাখ কোটি রুপি খরচ করবে সরকার। শুধু বর্তমান পাঁচ বছরের জন্যই তিনি বাজেটে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর কর্মসংস্থান বাবদ ১.৪৮ লাখ কোটি রুপি আলাদা করে রেখেছেন। তার মানে, কর্মসংস্থানের সব প্রকল্প চালাতে গিয়ে একজনের পেছনে তিনি খরচ করতে পারছেন ৪৮ হাজার ৭০৮ রুপি। কিন্তু আগেই তো বলে দেওয়া হয়েছে যে, শুধু ইন্টার্নশিপ প্রকল্পেই মাথাপিছু ব্যয় হচ্ছে ৬৬ হাজার রুপি। তাই এই তথ্যের বিভ্রান্তিগুলো তুলে বিরোধী নেতারা এখন নরেন্দ্র মোদির সরকার এবং বিজেপির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রচার শুরু করেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি প্রতিকূল। এখন এটাই দেখার, নরেন্দ্র মোদির মতো প্রশাসক ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা কিভাবে এই সংকটজনক অধ্যায়টাকে মোকাবেলা করেন।</p> <p><strong>লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</strong></p>