<article> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু ‘রাজনীতি’ নয়, বিনোদনে ভরপুর। একসময় এই দেশে ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে গ্রামে বা শহরে যাত্রাপালা আর সার্কাসের আসর বসত। এখন তার জায়গা নিয়েছে রাজনীতি নামের আরেক ধরনের বিনোদন। রাজনীতি এখন এক শ্রেণির মানুষের পেশা হয়ে গেছে, যারা জনগণের সামনে বিনোদনের মতো পরিবেশন করে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি হোক অথবা বাংলাদেশর মতো উন্নয়নশীল দেশ হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। তবে বাংলাদেশের মতো ভণ্ডামি ও বিনোদনপূর্ণ রাজনীতি অন্য দেশে আছে বলে জানা যায় না। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে মার্ক্সবাদে দীক্ষিত রাজনৈতিক দলগুলো একটি নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করার জন্য কট্টর মৌলবাদী জঙ্গি দলগুলোর সঙ্গে হাত মেলাতে পারে। নির্বাচন সামনে এলে কিছু ব্যক্তি রাজনীতির নাম করে এক বা একাধিক দোকান খুলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শূন্যে ছড়ি ঘোরাতে পারে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">এটি এমন একটি দেশ, যেখানে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী দেশের প্রতিষ্ঠাতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য বুলন্দ আওয়াজ তুলে রাজপথে পিটিয়ে পুলিশ আর সাংবাদিক হত্যা করতে পারে।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="বিনোদনে ভরপুর" height="296" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/24-03-2024/mk/kk-6-2024-03-24-01a.jpg" width="400" />বাংলাদেশের একটি দল বিএনপি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেনা শাসক জিয়াউর রহমান। জন্মের পর থেকে নানা ছলচাতুরী ও প্রতারণার মাধ্যমে দলটি ১৬ বছর ধরে দেশ শাসন করেছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">২০০৬ সালে এক গণ-আন্দোলনে ক্ষমতা হারায় বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধস নামানো বিজয় লাভ করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তারা সরকারে আছে। শেখ হাসিনা পর পর চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্বে রেকর্ড করেছেন।</p> <p style="text-align: justify;">২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি যে একটি অন্ধকার গর্তে পড়েছিল, সেই গর্ত থেকে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">জন্মের পর থেকেই দলটি তার প্রসার, টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সব সময় বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনায় জিয়া ও তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সহায়তা নিয়েছিলেন, তা এখন অবমুক্ত করা মার্কিন দলিলই জানিয়েছে। সঙ্গে ছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি আইএসআই থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল। ২০১২ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া এক জবানবন্দিতে তৎকালীন আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল আসাদ দুররানি বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন।</p> <p style="text-align: justify;">১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির  বিজয়ের পর বাংলাদেশ এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা সৃষ্টি, জঙ্গিবাদের প্রজনন আর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করার জন্য একটি নিরাপদ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এ জন্য আইএসআই এখানে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে।</p> <p style="text-align: justify;">২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর থেকে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রত্যাবর্তনের জন্য এতটাই মরিয়া ছিল যে তারা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করা থেকে শুরু করে দেশি ও বিদেশি বন্ধুদের নিয়ে যত রকমের ষড়যন্ত্র সম্ভব, সব কিছুই করেছে। এবার তারা শুধু আইএসআইয়ে ক্ষান্ত থাকেনি, ইসরায়েলের ভয়ংকর গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গেও শলাপরামর্শ করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি ও তার মিত্ররা চরম সহিংস পথ অবলম্বন করেছিল এবং দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দেশে পরিণত করতে চেয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণেই দেশ একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পথে রয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাঁচাতে বিএনপিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। ২০১৭ সালের জুনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন সফরকালে আইএসআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন এবং ২০১৮ সালের সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। কিছু টোকাই দলকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।</p> <p style="text-align: justify;">২০১৮ সালের অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী ফলাফলে বিএনপির ভার্চুয়াল অবলুপ্তি ঘটেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টার পরিবর্তে বিএনপি পশ্চিমের কিছু দেশের পাশাপাশি ভারতকেও বোঝানোর চেষ্টা করে যে তারাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র বাঁচানোর সেরা বিকল্প। অন্তত পশ্চিমের একটি দেশ বিএনপিকে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে সমর্থন ও প্রশ্রয় দিয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">৭ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচনের কয়েক দিন আগেও বিএনপি ও তাদের টোকাই মিত্ররা জনগণকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করেছিল তফসিল অনুযায়ী কোনো নির্বাচন হবে না। সব জল্পনাকল্পনা উপেক্ষা করে এবং বিএনপি ও তার মিত্রদের বর্জনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অনেকটা রাস্তায় রেখে বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করে।</p> <p style="text-align: justify;">আগামী নির্বাচন ২০২৯ সালের আগে না-ও হতে পারে। এই দীর্ঘ অপেক্ষা বিএনপির মতো দলের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এখন বিএনপি এক অদ্ভুত ‘আউট ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ আন্দোলনে নেমেছে। জনগণের কাছে আবদার করছে, তারা যেন সব ধরনের ভারতীয় পণ্য বর্জন করে। কারণ তারা ‘আওয়ামী লীগের মতো একটি দলকে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছে’। তারা ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের শত্রু বলেও ঘোষণা করেছে। এ ধরনের আন্দোলন শুধু অবাস্তব ও হাস্যকরই নয়, অযৌক্তিক ও আত্মঘাতীও বটে। আবার কয়েক দিন আগে বিএনপির সিনিয়র নেতা ড. মঈন খান বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ ভারতের সমর্থন চেয়েছেন।</p> <p style="text-align: justify;">ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই পরস্পরের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ভারত থেকে তুলা ও পোশাক শিল্পের জন্য বেশ কিছু কাঁচামাল, পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করে, যা বিএনপি নেতাদের মালিকানাধীন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরাও ব্যবহার করেন। তাঁরা কি এসব জিনিস আমদানি বন্ধ করবেন? আমাদের ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত যথেষ্ট অনেক কাঁচামালও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। পেঁয়াজ, চিনি এবং কখনো কখনো চালের মতো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভারত থেকে আমদানি না করলে আমাদের বাজার অস্থির হয়। এ বিষয়ে বিএনপির সুপারিশ কী? চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শত্রু, কিন্তু তাদের মধ্যে বাণিজ্য ক্রমাগতভাবে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। প্রতি মাসে হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছে, তাদের বেলায় বিএনপির কী পরামর্শ? বিএনপির নেতাকর্মীরা কি এই সেবা নেওয়া বন্ধ করবেন?</p> <p style="text-align: justify;">সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে শুধু ভারত নয়, চীন ও রাশিয়ারও সমর্থন ছিল। বিএনপি কখনোই ঘোষণা করে না যে চীন ও রাশিয়ার তৈরি পণ্যও বয়কট করতে হবে। সবচেয়ে বড় ‘তামাশা’ মঞ্চায়ন করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। গত বুধবার প্রকাশ্যে একটি শাল জ্বালিয়ে তিনি এক মজার তামাশা মঞ্চায়ন করেন। তিনি ঘোষণা করেন, এই শাল ভারতের তৈরি। তাঁর আকস্মিক স্টান্ট এখন পর্যন্ত তাঁর দলীয় সহকর্মী বা মিত্ররা সমর্থন করেননি। আরেকটি প্রশ্ন, বাংলাদেশ ভারতে যে কয়েক বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, সেসব রপ্তানি কি বন্ধ করে দিতে হবে? এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি মদদে একটি গণহত্যা চলমান আছে। রিজভী সাহেব কি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বর্জন করতে আহবান করবেন? কেউ কেউ বলে, চীনপন্থী মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি মোহামেদ মুইজু অনুরূপ একটি ডাক দিয়েছিলেন। মুইজুর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত মালদ্বীপে থাকা তাদের সেনা সদস্যদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। মনে রাখতে হবে, পাঁচ লাখ জনসংখ্যার দেশ মালদ্বীপের ৬.১৭ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির সঙ্গে ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের ৬৪২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির তুলনা করাটা অযৌক্তিক। মালদ্বীপের অর্থনীতি অনেকটা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। সেই দেশে ভারতের বিরাট বিনিয়োগ আছে। শেষ পর্যন্ত মালদ্বীপ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সময়ই বলে দেবে।</p> <p style="text-align: justify;">বিএনপির এত দিনে উপলব্ধি করা উচিত স্টান্টবাজি করে মানুষকে বিনোদন দেওয়া যায়, রাজনীতিতে কিছু অর্জন করা যায় না। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এখনো ঘুমের ঘোরে। তাদের জেগে ওঠার এবং বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক</strong><b><strong> :</strong> </b>বিশ্লেষক ও গবেষক</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="41" height="80" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/03/24/my1187/1711214698-3142e7c31e1d3cb464885650334cf55a.jpg" width="133" /></p> </article>