বিশ্বে মেটার পাশাপাশি অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়লেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামই এখনো জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছে, যদিও টিকটকের সেটাকে দ্রুতই ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পণ্য ও সেবাদানকারীরা ফেসবুক মার্কেটিংয়ের মাধ্যমেই সফলতার মুখ দেখছেন বেশি, বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ব্র্যান্ড সৃষ্টি করা এবং ক্রেতা জোগাড় করা সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায়। তবে ২০১৭ সালের পর থেকেই ফেসবুকে অডিয়েন্স তৈরি করা হয়ে গেছে কষ্টসাধ্য। প্রতিনিয়তই ফেসবুক তাদের অ্যালগরিদম ও এআইয়ের ডাটাসেট পরিবর্তন করায় ঠিক কিভাবে পোস্ট ভাইরাল করা বা পেজের লাইক ও ফলোয়ারসংখ্যা বাড়ানো যায়, সেটার ধরাবাঁধা কোনো উপায় নেই।
এদিকে দেশ থেকে পেজ ও পোস্ট বুস্ট করাও হয়ে যাচ্ছে কঠিন, এইচটিটিপুলের মাধ্যমে যারা বুস্ট করত তাদের দেখতে হচ্ছে অন্য উপায়।
অডিয়েন্স তৈরির ব্যাপারে ফেসবুক যা বলছে
পণ্য ও সেবা প্রদানকারীদের সরাসরি ফেসবুকের মাধ্যমেই ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা না করে আগে ব্র্যান্ডের প্রচার ও প্রসার বাস্তব দুনিয়ায় শুরু করার কথা শুরুতেই বলেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। দৃষ্টিকাড়া লোগো, ছোট ও অন্যূন একটি নাম, সঙ্গে মনে রাখার মতো স্লোগান এবং ব্র্যান্ডটিতে কী কী পণ্য ও সেবা পাওয়া যাবে তার তালিকা নিয়ে ছোটখাটো হলেও ক্যাম্পেইন চালিয়ে ব্র্যান্ডটির ব্যাপারে লোকমুখে প্রচারণা শুরু করে দিয়ে এরপর সেটার পেজ চালু করলে দ্রুতই মানুষ সেটা সার্চ করে বের করে ফলো করতে থাকে—এমনটাই তাদের ভাষ্য। অবশ্য যারা প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বরং যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত প্রচারণার জন্য পেজ করতে চাচ্ছে, তাদের জন্য এই নির্দেশনা কাজের নয়।
তবে নজরে পড়ার মতো লোগো, নাম ও স্লোগান বা ‘অ্যাবাউট’-এ লেখা বিবরণ সব ধরনের পেজের জন্যই জরুরি। সঙ্গে কী ক্যাটাগরিতে পড়ে পেজটি, সে অনুযায়ী পেজের সঠিক লে-আউট করা।
মজার বিষয় হচ্ছে, এরপর তাদের দেওয়া গাইডলাইনে রয়েছে পেজটি বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করা এবং তাদের লাইক ও ফলো দেওয়ার জন্য আহবান করার কথা। পেজ খোলার পর সবাই এ কাজ করে থাকে, যদিও সেটা ফলপ্রসূ হয় কমই।
সেটা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী যারা ফেসবুকে ব্যক্তিগতভাবে তেমন পোস্ট করে না, বন্ধুতালিকার মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ তেমন ভালো নয়, তাদের জন্য এভাবে অডিয়েন্স তৈরি করাটা অত্যন্ত কঠিন। শুরুতেই নিজের প্রফাইলের রিচ বাড়াতে হবে, এবং পেজে কী কী থাকবে মেটার ওপর সুন্দর করে আলাদা পোস্ট লিখে এরপর সেটা শেয়ার করে অডিয়েন্স দ্রুত তৈরি করা সম্ভব, অন্তত মেটার তথ্য সেটাই বলছে। পেজ অ্যাডমিনের বাইরেও অন্য ব্যবহারকারীরা সেটা শেয়ার করছে কি না, সেটার ওপরও মেটা অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই বন্ধুদের পেজ শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করাও সমীচীন। নিউজফিডের চেয়েও আজকাল স্টোরির রিচ আরো বেশি হওয়ায় পেজের বিষয়বস্তু ও লিংক দিয়ে চোখ আটকে যাওয়ার মতো আকর্ষণীয় স্টোরি তৈরি করে শেয়ার করেও অডিয়েন্স তৈরি করা যেতে পারে, বলছে মেটা।
সব শেষে মেটা বলছে, পেজের সঙ্গে মিল আছে এমন বিষয়বস্তুর গ্রুপে নিজের প্রফাইল ব্যবহারের বদলে পেজ থেকেই সরাসরি পোস্ট করে বা কমেন্ট করেও পেজের অডিয়েন্স বাড়ানো সম্ভব। বিশেষ করে যারা এর মধ্যেই বড়সড় গ্রুপ তৈরি করেছে, তারা সেই গ্রুপের সঙ্গে পেজ যুক্ত করে সেখান থেকেও দ্রুত লাইক ও ফলোয়ার পেতে পারে।
ব্যাবসায়িক পেজের ক্ষেত্রে রিকমেন্ডেশন ফিচারটি চালু রাখার কথা বলছে ফেসবুক, যাতে ব্যবহারকারীরা পেজটির সেবা মানসম্মত কি না, সেটার রিভিউ দিতে পারে। যেসব পেজে রিকমেন্ডেশন বেশি, সেগুলো বুস্টিং ছাড়াও ব্যবহারকারীদের সামনে তুলে ধরে ফেসবুক। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের সময়সূচি এবং ঠিকানা ও যোগাযোগের ফোন নম্বর ও ওয়েবসাইট যুক্ত করার জন্যও পরামর্শ দিয়েছে মেটা। রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রে খাবারের মেন্যু এবং পণ্য বিক্রেতাদের জন্য শপ ফিচারগুলোও কার্যকর।
পেজের রিচ ধরে রাখতে করণীয়
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রথম কয়েক শ লাইকের পর পেজের রিচ কমতে থাকে। সেটার মূল কারণ হিসেবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এবং সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটাররা দায়ী করেছেন মানহীন পোস্ট ও নিয়মানুবর্তিতার অভাবকে। প্রতিদিন অন্তত দুটি পোস্ট করা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা, কিছু ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয়টিও করা যেতে পারে, কিন্তু অতিরিক্ত পোস্ট করলে সেটা স্প্যামিং হিসেবেও ধরতে পারে ফেসবুকের অ্যালগরিদম, সে ক্ষেত্রে উল্টা রিচ কমে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। লিখিত পোস্টের চেয়ে নজরকাড়া ছবি বা রিলস রিচ বেশি পায়। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রতিটি পোস্টের ছবি বা ভিডিওর ফরম্যাট কাছাকাছি হতে হবে, যাতে সেটা ব্র্যান্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য ধরে রাখতে পারে এবং অডিয়েন্সের মনে জায়গা করে নিতে পারে সহজেই। একই ফ্রেমিং ও কালার গ্রেডিংয়ে করা ছবি বা ইনফোগ্রাফের ক্ষেত্রে কালার প্যালেট ও ডিজাইন ফরম্যাট ধরে রাখা, ভিডিওর ক্ষেত্রে সেটা ইন্ট্রো, সেট ও থাম্বনেইলের ডিজাইন এক ফরম্যাটে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে আছে লেখার ভাষা ও টোন সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা, বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষায়ই পোস্ট করা যেতে পারে, কিন্তু মিশ্রিত ভাষা বা ‘মুরাদ টাকলা’ ভাষা ব্যবহার একেবারেই কাম্য নয়।
ছবি ও ভিডিওতে বিশেষ করে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে পোস্টের রিচ অর্গানিকভাবেই বাড়ানো সম্ভব। পোস্টের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে কিছু হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করার পাশাপাশি নিজস্ব কিছু হ্যাশট্যাগ তৈরি করলে পরবর্তী সময়ে পোস্টগুলো নিজেরও যেমন খুঁজে পেতে সহজ হবে, তেমনি অডিয়েন্সও চাইলে নতুন পোস্টের সঙ্গে সম্পর্কিত পুরনো পোস্টগুলো হ্যাশট্যাগে ক্লিক করে পেয়ে যাবে। এ ছাড়া ছবি আপলোড করলে তার অল্ট-টেক্সটে অবশ্যই ছবি ও পোস্টের বিষয়বস্তু ঠিকঠাকভাবে দিতে হবে, কেননা অল্ট-টেক্সট থেকেই ছবিটি কী লিখে সার্চ করলে পাওয়া যাবে সেই তথ্য সার্চ ইঞ্জিন ইনডেক্স করে থাকে।
ঠিকঠাক পোস্ট ও কনটেন্ট তৈরি করলেই চলবে না, সেটা কোন সময় পোস্ট করতে হবে, সেটারও রুটিন তৈরি করা জরুরি। পেজের ইনসাইটস থেকে দেখতে হবে অডিয়েন্স কোন বয়সী, কোন সময় তারা অনলাইনে থাকে, কোন সময়ের পোস্টগুলোতে তারা বেশি লাইক ও কমেন্ট করেছে। যেমন—রেস্টুরেন্টের পোস্ট সকালে করার চেয়ে দুপুরে করলেই রিচ বেশি পাওয়া যায়, আবার রাতে জীবনধর্মী পোস্ট বেশি রিচ পেলেও সকালে খবরজাতীয় পোস্টের রিচ থাকে বেশি—এমন বহু কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি রয়েছে।
পোস্টের কমেন্টের উত্তর দেওয়া পেজের ইন্টার-অ্যাকশন বাড়াবে, পেজের পোস্টগুলো কমেন্টকারীর বন্ধুদের ওয়ালেও হাজির হয়ে যাবে। ইনবক্সে আসা মেসেজের সঠিক সময়ে উত্তর দেওয়াও খুবই জরুরি। এ দুটি জিনিসকেই ফেসবুক পেজের অ্যাক্টিভিটি হিসেবে দেখে থাকে। অ্যাক্টিভিটি বাড়ানোর চমৎকার উপায়, পোস্টে কমেন্ট করার জন্য উৎসাহিত করা এবং পোল ফিচারটির ব্যবহার। লাইভ ভিডিওতেও দ্রুত পেজের ইন্টার-অ্যাকশন বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
বুস্ট ক্যাম্পেইন
ফেসবুকে অর্গানিক রিচের ওপর ভরসা করে ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়, চাই টাকা দিয়ে সেটা বুস্ট করা। বুস্টেরও আছে রকমফের, তাই আগে চিন্তা করতে হবে বুস্ট থেকে কী আশা করা হচ্ছে। যদি পেজে লাইক বাড়ানো হয়ে থাকে লক্ষ্য, সে ক্ষেত্রে পেজের সারমর্মধারী পোস্ট বুস্ট করা কার্যকর। একইভাবে পণ্য ও সেবার পোস্টগুলো বুস্ট করেও আরো বেশি অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানো যাবে। আবার এদিকে শুধু ব্র্যান্ড সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পোস্ট নয়, পেজ বা ওয়েবসাইট বুস্ট করা অধিক কার্যকর। অনেক সময় বাস্তব দুনিয়ার অ্যাক্টিভেশন ক্যাম্পেইনের ইভেন্ট ফেসবুকে বুস্ট করে ভার্চুয়াল ও বাস্তব—দুই দুনিয়ায়ই নতুন ফ্যান পাওয়া সম্ভব।
পোস্ট বুস্ট করার আগে অবশ্যই পেজ ইনসাইটস দেখে সেখান থেকে টার্গেট ডেমোগ্রাফিক বেছে নিতে হবে। কী ধরনের অডিয়েন্স এর মধ্যেই বেশি ফলো করছে, তেমন অডিয়েন্সকে লক্ষ করে তবেই বুস্ট করা উচিত। আর অবশ্যই নির্ভরযোগ্য এজেন্সি ছাড়া পেজ বুস্ট করা উচিত নয়, তা না হলে পেজ হারানোর আশঙ্কাই থাকবে সবচেয়ে বেশি। তবে দিনশেষে অর্গানিক রিচের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টার পরই বুস্টিংয়ে যাওয়া উচিত, তা না হলে অল্প কিছু ফলোয়ারের পেজ থেকে পণ্য ও সেবা বুস্ট করা হচ্ছে দেখে উল্টা অডিয়েন্সের আস্থা হারানোর আশঙ্কা রয়ে যাবে।