<p>বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, লেখক, প্রকাশক, কূটনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দার্শনিক—এককথায় বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন একবার বলেছিলেন, ‘কূপ শুকিয়ে গেলে আমরা পানির মূল্য বুঝতে শিখি।’ আসলে আমরা অনেকে বুঝি না যে পৃথিবীর মোট পানির তুলনায় আমাদের ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ খুবই কম। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ওয়েবসাইটের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী পৃথিবীর বিপুল পরিমাণ পানির ৯৭ শতাংশ হচ্ছে নোনা পানি। বাকি মাত্র ৩ শতাংশ হচ্ছে স্বাদু পানি বা মিঠা পানি। আবার এই ৩ শতাংশ স্বাদু পানি বা মিঠা পানির ৬৯ শতাংশ জমাট বেঁধে আছে হিমবাহ কিংবা মেরু অঞ্চলে এবং ৩০ শতাংশ আছে ভূগর্ভে। বাকি মাত্র ১ শতাংশ ভূপৃষ্ঠে মিঠা পানি অবস্থায় আছে আমাদের ব্যবহারের জন্য।</p> <p>জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে (২০২৩) উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত ৪০ বছরে পৃথিবীতে ১ শতাংশ হারে মিঠা পানি ব্যবহারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব (২০২২) অনুযায়ী, উত্তর আমেরিকা ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পানি উত্তোলন করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে পৃথিবীতে মিঠা পানি ব্যবহারের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি শতকের মাঝামাঝি চাপ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন সংস্থার করা জরিপে দেখা যাচ্ছে, এখনই পৃথিবীর বহু জায়গায় তৈরি হয়েছে চরম পানিসংকট।</p> <p>জাতিসংঘ বলছে যে পানিসংকটের কারণে পৃথিবীতে অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে। পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ পানির জন্য তাদের দেশের সীমানার বাইরে থেকে আসা পানির ওপর নির্ভরশীল। মাত্র ২৪টি দেশের মধ্যে পানিবণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা নেই। বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তবতায় দেশের মধ্যে কিংবা বিদেশের সঙ্গে মিলেমিশে পানি সংরক্ষণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পানি সমস্যাকে কেন্দ্র করে অতীতে অনেক সংঘর্ষ হয়েছে। আগামী দিনে এই সংঘর্ষ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। এই বাস্তবতায় এবারের (২২ মার্চ ২০২৪) বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘শান্তির জন্য পানি’।</p> <p>বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের যৌথ প্রতিবেদনে (২০২৩) উঠে এসেছে, ২০২২ সালে পৃথিবীতে ২২০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানি পান করতে পারেনি। এর মধ্যে ১১ কোটি মানুষ ভূপৃষ্ঠস্থ বিভিন্ন উৎস থেকে পানি পান করতে বাধ্য হয়েছে। উল্লিখিত প্রতিবেদনে পৃথিবীর সাড়ে ৩০০ কোটি মানুষের নিরাপদ স্যানিটেশন থেকে বঞ্চিত থাকাসহ প্রায় ৪২ কোটি মানুষের উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে।</p> <p>বর্তমানে প্রায় ২৫ শতাংশ কৃষিজমিতে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এই না পাওয়ার কারণ যতটা না পানিচক্রকেন্দ্রিক (বৃষ্টিপাত, ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি, নিষ্কাশন ইত্যাদি), তার চেয়ে বেশি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর অনেক জায়গায় অবকাঠামোগত দুর্বলতার জন্য কৃষিজমিতে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ভূমি ও পানি বিভাগের পরিচালক ড. লিফেং লি বলেছেন (২০২৩), ‘পানি ঘাটতির অর্থ হচ্ছে কৃষি উৎপাদনের জন্য কম পানি পাওয়া। চূড়ান্তভাবে তার অভিঘাত তৈরি হয় খাদ্য উৎপাদনে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি হুমকির মধ্যে পড়ে।’ তাঁর কথায়, ‘২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি। সীমিত পানিসম্পদের মধ্যেই তখন আরো বেশি খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজন হবে।’</p> <p>পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশেই এখন পানিদূষণ ঘটছে। শিল্প থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক গিয়ে পড়ছে পানির মধ্যে। কৃষিজমি থেকে আসা পানিসহ বর্জ্য পানির কারণেই বেশি করে পানিদূষণ ঘটছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকস, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ নতুন নতুন দূষণকারী বস্তু পানির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ বর্জ্য পানি কোনো রকম বিশুদ্ধকরণ ছাড়াই জলাশয়ে গিয়ে পড়ছে। সিডিপির (কার্বন ডিসক্লোজার প্রজেক্ট) করা এক প্রতিবেদেনে (২০২১) বলা হয়েছে, পৃথিবীর ৪০ শতাংশেরও বেশি কম্পানি তাদের বর্জ্য পানি পরীক্ষা করে না। মাত্র ১২ শতাংশ কম্পানি বর্জ্য পানির দূষণমাত্রা নির্ধারণ করে এবং ৫ শতাংশেরও কম কম্পানি সাফল্যের সঙ্গে দূষণ রোধ করতে সক্ষম হয়েছে।</p> <p>জাতিসংঘের একটি হিসাব বলছে, ‘পৃথিবীতে ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে বন্যার কারণে ৬৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ১৬৫ কোটি মানুষ। মৃত্যু হয়েছে এক লাখ মানুষের। এই সময়ের মধ্যে খরায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ।’ কয়েক বছর আগের (২০১৮) করা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্ত সরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে গেলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল (দক্ষিণ ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ) এবং আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে।</p> <p>ওপরের এই তথ্য ও পরিসংখ্যান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে পৃথিবীতে এখন মিঠা পানির সংকট দূর করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। সংগত কারণেই তাই এই সংকট মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে নানা ধরনের প্রস্তাব আসছে। এসব প্রস্তাবের মূলকথা হচ্ছে, যে দেশে যেটুকু মিঠা পানি আছে, তার সর্বোচ্চ সাবধানী ও স্থায়ী ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এ ছাড়া খরাপীড়িত দেশ কিংবা অঞ্চলের পানি সংরক্ষণ সংক্রান্ত স্থানীয় কৌশলও অনেক জায়গায় কাজে লাগানো যেতে পারে।</p> <p>প্রভাবশালী জার্নাল নেচার (৩ আগস্ট ২০২৩) তার সম্পাদকীয়তে এ সম্পর্কে কয়েকটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছে। এই সম্ভাবনার মধ্যে বিশাল তারের জাল দিয়ে মেঘ বা কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। নেচার বলছে যে পেরু ও চিলিতে এই কৌশল ব্যবহার করে মেঘ কিংবা কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া ঠাণ্ডা মৌসুমের বরফ জমা করে তা শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা যেতে পারে। চীনে এই কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে বলে নেচার উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া নোনা পানিকে ঝিল্লি-পাতন (মেমব্রেন ডিস্টিলেশন) প্রক্রিয়ায় অতি কম তাপমাত্রায় বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তর করার কৌশল সম্পর্কেও নেচার বলেছে।</p> <p>সম্প্রতি পানি ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন কৌশল (স্কেল) ব্যবহার করা হচ্ছে। কৌশলটির উদ্ভাবক হচ্ছেন নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র) কর্মরত চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সেরা এল ইয়ং ও তাঁর সহযোগীরা। নতুন এই কৌশলটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওয়াইজ’ (ওয়াটার ইনসিকিউরিটি এক্সপেরিয়েন্স স্কেলস)। এই কৌশলে ব্যক্তির পানি নিরাপত্তাহীনতার মূল্যায়ন করা হয়। মূলত ‘প্রবেশাধিকার, প্রাপ্যতা, নির্ভরযোগ্যতা ও গুণগত মান’ এই চারটি বিষয়কে এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়। নেচারের (৩ আগস্ট ২০২৩ সম্পাদকীয় অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীর ১০০টি দেশসহ আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা ‘ওয়াইজ’ অনুসরণ করছে।</p> <p>একসময়ের পানিসম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এখন পানিসংকটে ভুগছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে দেশের অনেক জায়গায় পানিস্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির গুণগত মানও ভালো নয় বলে জানা গেছে। প্রধানত গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানার বর্জ্যগুলো এবং কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও বিষের কারণেই পানিদূষণ ঘটছে।</p> <p>বাংলাদেশে এখন প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন হয়, যার ৭৩ শতাংশ পানি নিয়ে আসা হয় ভূগর্ভ থেকে। ফলে দেশের অনেক জায়গায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ও বিদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানী এক যৌথ প্রকাশনায় (নেচার, ২৭ অক্টোবর ২০২২) বলেছেন, অত্যধিক সেচ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের ভূগর্ভস্থ মজুদ পানি কমে আসছে। তাঁদের মতে, বাংলাদেশের পানি নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন নিবিড় গবেষণা। পানি ব্যবহার, পানির গুণগত মান, প্রবাহ এবং পূর্বাভাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য পানি নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একান্তভাবে প্রয়োজন। আসলে পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রকৃত গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।</p> <p> </p> <p>লেখক : উপাচার্য, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক</p> <p>রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p> </p>