<p>আমি শ্রেণিকক্ষে প্রায়ই শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করি, কে কে শিক্ষকতায় আসতে চাও? এর উত্তরে ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র তিন-চারজন শিক্ষার্থী শিক্ষকতায় যাওয়ার আগ্রহ দেখায়। অথচ আদিকাল থেকেই শিক্ষকতা একটি মহান ও আদর্শ পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরই শিক্ষকতায় আশার আগ্রহ থাকা উচিত। কিন্তু আদর্শ হলেও শিক্ষার্থীরা কেন শিক্ষকতার দিকে ঝুঁকছে না, এ প্রশ্নটি প্রায়ই মাথায় ঘুরপাক খায়। পরক্ষণেই এর উত্তরে পাওয়া যায় যে পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার সংকট থাকলে কেন মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসবে।</p> <p>আর এ প্রসঙ্গটি অধিকভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকতার ক্ষেত্রে দেখা যায়। মেধাবীরা কোনোভাবেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকতায় যেতে চায় না। এমনকি বিসিএসের ফরম পূরণ করতে গিয়ে চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ক্যাডারটিকে পছন্দক্রমের শেষ দিকেই রাখেন। আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকতায় মেধাবীরা পছন্দ করে আসে না বললেই চলে। অথচ শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষার সব স্তরেই মেধাবীদের আকর্ষণীয় করে তোলা জরুরি। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো শিক্ষার্থী গড়ে তোলা যাবে না। কাজেই শিক্ষকতায় মেধাবীদের আগ্রহ বাড়াতে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ইস্যুতে আন্দোলনে মাঠে নামতে হয়। সরকার প্রতিশ্রুতি দিলে শিক্ষকরা আন্দোলন স্থগিত করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আবার একই ইস্যুতে আন্দোলনে নামতে দেখা যায়। এভাবে শিক্ষকদের দাবি পূরণে সরকারের অনীহার মূল কারণ কী সেটি চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।</p> <p>গত ১৫ মার্চ বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মানববন্ধন করেন। এমনকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসককে মাধ্যম করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন শিক্ষকরা। স্মারকলিপির বিষয় হলো, ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড বৈষম্য নিরসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও নির্বাচনের আগে অডিও ভয়েস কলের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও ৯ মার্চ ২০১৪ তারিখ থেকে শতভাগ পদোন্নতিসহ ১১তম গ্রেডে বেতন প্রদান। এর আগেও বহুবার এ বিষয়ে নানা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে শিক্ষকদের। সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও এর বাস্তবায়নে গড়িমসি লক্ষ করা যাচ্ছে। মূলত সহকারী শিক্ষকরা বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবিতে ২০১৪ সাল থেকে আন্দোলন করে আসছেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর লক্ষাধিক সহকারী শিক্ষক ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরণ অনশনে বসলে ২৫ ডিসেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী, সচিব এবং প্রাথমিক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক উপস্থিত হয়ে বেতনবৈষম্য নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিলে শিক্ষকরা অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেন।</p> <p>প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দূর করার বিষয়টি প্রথম থেকেই বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক দশম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষকরা ১৪-১৫তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড—এ গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ৩৭ হাজার ৬৭২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে শিক্ষকসহ সরকারীকরণ করেছিলেন। তখন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক উভয়েই ১৩৫ টাকা মূল বেতন পেতেন। তবে প্রধান শিক্ষকরা মাসিক ১০ টাকা হারে কার্যভার ভাতা বেশি পেতেন। ১৯৭৭ সালে সহকারী শিক্ষকদের ১৭তম গ্রেডে এবং প্রধান শিক্ষকদের ১৬তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হলে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ২০০৬ সালে বেতনবৈষম্য হয় দুই ধাপে এবং ২০১৪ সালে এসে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে তিন ধাপে দাঁড়ায়। এই বৈষম্য নিরসনে নানাভাবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি এলেও এর বাস্তবায়ন করা হয়নি।</p> <p>প্রতিনিয়ত নীতিমালা পরিবর্তন শিক্ষকদের মানসিক পরিস্থিতিকেও সংকটাপন্ন করে তোলে। সম্প্রতি সংশোধিত বিধিমালায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ নামে নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিধিমালায় প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তন করে সহকারী শিক্ষকদের ১২তম গ্রেডে আর প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডে বেতন প্রদানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এসংক্রান্ত প্রস্তাবিত বিধিমালা গত ৩ মার্চ ২০১৯ তারিখ রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করেন। শিগগিরই তা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।</p> <p>শিক্ষকতাকে মর্যাদাহীন করে রাখা, নানা ধরনের বৈষম্যের মধ্যে রাখা দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্ক। বিদ্যালয় চালাতে নানা ধরনের পদের লোকের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের বেতনবৈষম্য সৃষ্টির প্রবণতা কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বর্তমানে বিদ্যমান বেতনবৈষম্য দূর করার জন্য সব শিক্ষকের প্রথম শ্রেণির বেতন স্কেলসহ প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের সম্মানজনক দায়িত্বভাতা প্রদান করার মাধ্যমেও এর সমাধান করা যায়। যার ফলে দূর হবে শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য এবং রক্ষা পাবে সরকার তথা জাতির সম্মান।</p> <p>বর্তমান প্রেক্ষাপটে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টির পাশাপাশি অফিস সহকারীর পদও সৃষ্টি করা প্রয়োজন হতেই পারে। কিন্তু দেশের লাখ লাখ সহকারী শিক্ষকের দীর্ঘদিনের বেতনবৈষম্য, এমনকি এই বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের প্রতিশ্রুতিতে তারা যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছেন, তা ভূলুণ্ঠিত হতে চলেছে। এ কারণে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টির বিষয়টিকে তাঁদের অনেকেই বৈষম্য বজায় রাখার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। নানা প্রেক্ষাপটে সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক প্রত্যাশা প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপের বেতন। আর সেটি বাস্তবায়নে বেতনবৈষম্য না করে বঙ্গবন্ধুর সময়ের প্রচলিত প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর বিধান ও নীতি অনুসরণ করে বিশেষ ভাতা প্রদানের মাধ্যমে নতুন পদ সৃষ্টি করলে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের সুযোগ তৈরি হতে পারে। তা না হলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য পূরণ না হয়ে আগের অবস্থান চিরস্থায়ী হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।</p> <p> </p> <p>লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ</p> <p>রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>sultanmahmud.rana@gmail.com</p> <p> </p>