<p>প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ল। এটি স্বস্তির বিষয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান গ্রেডগুলো সমন্বয়ের ঘোষণা দেন। এর আগে শ্রম মন্ত্রণালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে গ্রেডগুলো সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত জানানো হয়।</p> <p>আশির দশকে বাসাবাড়িতে ছোট পরিসরে যে পোশাকশিল্পের সূচনা হয়েছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেটিই এখন সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিচ্ছে। চীনের পর বাংলাদেশই হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। পাঁচ হাজারেরও বেশি কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ কিংবা তারও বেশি শ্রমিক কাজ করে। অথচ বিপুল সম্ভাবনাময় এই শিল্প আজ এক কঠিন সংকটের আবর্তে আটকে যাচ্ছে। শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তাসহ নানা ইস্যুতে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ এখন হুমকির সম্মুখীন।</p> <p>এ কথা সত্যি, বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের একের পর এক সমৃদ্ধি ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়েনি শ্রমিকের জীবনমান। উল্টো একের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের জীবন যাচ্ছে অকাতরে; যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হচ্ছে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু। এ ছাড়া ২০০৫ সালের পর শুধু অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনায়ই প্রাণ হারিয়েছে ছয় শতাধিক শ্রমিক। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে সারা বিশ্বে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। বহুদিন থেকেই এ ব্যাপারে ট্রেড ইউনিয়নগুলো সোচ্চার। কিন্তু যে তুলনায় পোশাকশিল্পের উন্নয়ন হয়েছে, সে তুলনায় শ্রমিকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পরিস্থিতির যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা-ও বিদেশি বায়ারদের নানা শর্ত পূরণ করতে গিয়ে। অর্থাৎ বিদেশি ক্রেতারা শ্রমিকের জীবনমান নিয়ে যদি কোনো প্রশ্ন না তুলত, তাহলে মালিকপক্ষ এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিত কি না সন্দেহ।</p> <p>সত্যিকার অর্থে শ্রমিকের ইতিহাস হচ্ছে বঞ্চনার ইতিহাস। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও কাজের নিশ্চয়তা প্রদানকে অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় শ্রমনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শ্রমনীতিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ন্যূনতম ১০০ শ্রমিক থাকলেই সেখানে ইউনিয়ন করা যাবে। এ ছাড়া বলা হচ্ছে, নয়া নীতি অনুযায়ী পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের বেতনবৈষম্য দূর করা হবে। একই সঙ্গে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি বা পুনর্নির্ধারণ এবং গঠন করা হবে স্থায়ী মজুরি কমিশন বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের সব শ্রমিককে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ও অবসর ভাতা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো মালিক শ্রমিকদের এই সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করলে তাঁরও ব্যাবসায়িক সনদ বাতিলের বিধান শ্রম আইনে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এই নীতিতে। শ্রমনীতিতে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি পাওনার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই নীতি অনুযায়ী সরকার শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। এই লক্ষ্যে  নিম্নতম মজুরির মানদণ্ড নির্ধারণ, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিয়মিত পর্যালোচনা, শ্রমিকের দক্ষতা ও কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বিভিন্ন স্তরের মজুরি নির্ধারণ, নারী-পুরুষ ও দেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে মজুরির সমতা নিশ্চিত করবে সরকার।</p> <p>১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেশির ভাগ শিল্প ও সার্ভিস প্রতিষ্ঠান জাতীয় করা হয়। জাতীয়করণের পর এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানা অসুবিধা দেখা দেয়। এজাতীয় সমস্যা নিরসনে সেই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শ্রমমন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী দেশে প্রথম শ্রমনীতি ঘোষণা করেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রগতির লক্ষ্যে শিল্পে শান্তি বজায় রাখাই ছিল এই নীতির মূল উদ্দেশ্য। বর্তমানে দেশে শিল্প খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ লাখ। এর মধ্যে গার্মেন্ট খাতেই শ্রমিক রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ। কিন্তু বিদ্যমান শ্রমনীতিতে শ্রমিকদের এসব ব্যাপারে সুষ্ঠু দিকনির্দেশনা না থাকায় তাদের পরিচালনায় নানা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। শ্রমিকদের ঘামে মালিকদের প্রাসাদোপম অট্টালিকা তৈরি হলেও অনেক শ্রমিককে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়। দিনরাত শ্রম দিয়েও জীবনের ন্যূনতম চাহিদা তারা পূরণ করতে পারে না। অনেক সময় শ্রমিক তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য পথে নামতে বাধ্য হয়।   </p> <p>দেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরাও বঞ্চনার শিকার। দৈনিক ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করে অনেক শ্রমিকই ন্যায্য মজুরি পায় না। এর ওপর বেতন বকেয়া, কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, লকআউট ইত্যাদি কারণেও শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত থাকে না। আবার অনেক ফ্যাক্টরির কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার দরুন অনেক শ্রমিককে দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে। দুর্ঘটনা মোকাবেলার জন্য কারখানাগুলোতে আলাদা সিঁড়ি থাকার কথা থাকলেও কোনো কোনো কারখানায় তা নেই। একটি কথা সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ছাড়া শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। এ জন্য শ্রমনীতির যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। শ্রমিক ঠকানোর মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে শিল্পের চরম উৎকর্ষের যুগে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে, এটিই তো স্বাভাবিক।</p> <p>পোশাকশিল্পের অমিত সম্ভাবনার কারণে এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন গার্মেন্ট মালিকরা। এমনকি শুল্ক সুবিধা দেওয়া ছাড়াও নানা সময় নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়। এসবের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে শেষ পর্যন্ত তা যেন শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে পোশাকশিল্পের মতো শ্রমঘন একটি শিল্পে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক অনেক প্রকট।</p> <p>এ কথা ঠিক, জনসংখ্যাধিক্যের এ দেশে সস্তা শ্রমের কারণেই বিদেশি বায়াররা এ দেশের পোশাকশিল্পের দিকে ঝুঁকেছেন। এ কারণে চীনের পর বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হলে সব পক্ষেরই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যার যে দায়িত্ব সেটি পালন করতে হবে নিষ্ঠার সঙ্গে। শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের ব্যাপারে সবাইকেই ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। যখন-তখন কারখানায় ভাঙচুর-ধর্মঘট করার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মালিক-শ্রমিক আস্থার সম্পর্ক ব্যতিরেকে গার্মেন্ট সেক্টর এগিয়ে যেতে পারে না। কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত-সহিংসতাও পোশাকশিল্পের ভবিষ্যেক কণ্টকাকীর্ণ করছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বশীল হতে হবে।</p> <p>আর একটি কথা। গার্মেন্ট সেক্টরে কাঁচামাল আমদানির দিকে নজর দিতে হবে। তুলা আমদানি বা উৎপাদন করে সেখান থেকে সুতা তৈরি করতে হবে। সুতা থেকে কাপড় বানাতে হবে। সেই কাপড় সেলাই করেই তৈরি হবে পোশাক, যাতে লেখা থাকবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। মোট কথা গার্মেন্ট সেক্টরে উন্নতি করতে হলে শুধু সেলাইনির্ভর ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। </p> <p>লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট</p> <p>harun_press@yahoo.com</p> <p> </p> <p> </p>