<p>জনসংখ্যার দিক থেকে এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ। ১৯০১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় পৌনে তিন কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ নমুনা জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী লোকেরাই দেশের কর্মক্ষম জনশক্তি।</p> <p>অনেকেই বলে থাকে, পারমাণবিক অস্ত্র অপেক্ষা জনসংখ্যা বর্তমান বিশ্বের প্রধান সমস্যা। তাদের অভিমত, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষত আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা যুক্তি তুলে ধরেন—ভৌগোলিক পরিবেশ, অশিক্ষা, নিম্ন মানের জীবনযাত্রা, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব, খাদ্যাভ্যাস, শিশু বিবাহ, বহু বিবাহ, ছেলেসন্তান লাভের আশা, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, মৃত্যুর হার হ্রাস, বিনোদনের অভাব, দারিদ্র্য, কর্মহীনতা, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের জনসংখ্যা সীমিত রাখার জন্যই এক্ষুনি কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।</p> <p>কিন্তু বাস্তবিক অর্থে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি খুব একটা উদ্বেগজনক ব্যাপার নয়। বরং এ জনসংখ্যাকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে জনশক্তিই হবে দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরে সঠিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা বেশি প্রয়োজন।</p> <p>সম্প্রতি দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোতে ক্রমেই কর্মক্ষম জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বাড়ছে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা। কোনো কোনো দেশ বয়স্ক মানুষের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স এখন ২৪ বছর বা তার নিচে। তরুণ জনগোষ্ঠীর এই সুবিধা বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সদ্ব্যবহার আমাদের করা দরকার। কেননা বর্তমানে বৈশ্বিক জনমিতির সর্বোচ্চ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে যতটুকু জানা যায়, আমাদের দেশের সরকার এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর। এরই মধ্যে মানবসম্পদ তৈরির বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যেহেতু দক্ষ ও জনভিত্তিক সমাজ গঠনই বর্তমান সরকারের মূল উদ্দেশ্য, তাই ক্রমবর্ধমান যুবগোষ্ঠীকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য তাদের চাহিদামাফিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে।</p> <p>বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে অনেকেই বোঝা মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা কখনো বোঝা নয়। দেশের জনসংখ্যা সহনীয় মাত্রায় ধরে রাখার পাশাপাশি এই জনসংখ্যাকে যদি জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, তাহলে আমাদের দেশের জনসংখ্যা হবে সবচেয়ে বড় সম্পদ। তবে এ জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ। দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারলেই তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তারা স্বমহিমায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সে ক্ষেত্রে দেশে যাতে তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এর পাশাপাশি কলকারখানা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে দেশের মানুষকে কাজ করার পথ করে দিতে হবে, যাতে দক্ষ জনশক্তি তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, মেধা ও শ্রম ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারে।</p> <p>পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারের দরজা বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। দুবাইয়ে আমিরাতের মিনিস্ট্রি অব হিউম্যান রিসোর্সেস অ্যান্ড এমিরেটাইজেশনের দপ্তরে বাংলাদেশ ও আমিরাতের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার পর থেকেই বাজারটি খুলে গেছে। এখন সেখানে সব ধরনের কর্মী পাঠানো যাবে। শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতে নয়, বিশ্বের সর্বত্র সুদক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি করা গেলে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। বর্তমান সময়ের উপযোগী সুদক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। দেশের পেশাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা প্রকৌশল, কৃষি, চিকিৎসা, কারিগরি ইত্যাদি জনসংখ্যা অনুপাতে এখনো অনেক কম। ফলে বেকারত্বের হার কমানোর ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। স্মরণযোগ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান তার কারিগরি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে। এখন চীন বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক পরাশক্তি। তাদের এই অভূতপূর্ব সাফল্যের মূল কারণ হচ্ছে সময়োপযোগী প্রযুক্তিকে বাহন করে নিজেদের শ্রম ও মেধাকে কাজে লাগানো। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে সবার আগে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ জরুরি। সেই বিবেচনায় কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষা হলো দক্ষ জনশক্তি তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত।</p> <p>আমাদের দেশের সম্পদ সসীম আর অভাব অসীম। সসীম সম্পদ দিয়ে অসীম অভাব কুলায় না। কিন্তু এই তথ্যের সঙ্গে একমত হওয়া যায় না। কারণ দেশের সম্পদ যা-ই থাকুক, এই সম্পদেরই যদি সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায় এবং শিক্ষার আলো দিয়ে দেশে যদি দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যায়, তাহলে সময়ের সঙ্গে তাদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে পারলে দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে তখন আর কোনো অভাব হবে না, যদি জনসংখ্যা প্রাকৃতিক নিয়মেও বাড়ে।</p> <p>তাই আমাদের দেশের মানুষ বোঝা নয়, বরং সম্পদ। কারণ প্রত্যেক মানুষই একেকটি সৃষ্টিশীল কাজের বড় শক্তি। একজন মানুষের কর্মোদ্যম, সৃজনশীলতা, মেধা আর শ্রমের মাধ্যমে সৃষ্টি হতে পারে কোনো এক মহাবিস্ময়, যা পৃথিবীকে চমকে দিতে পারে।</p> <p><strong>লেখক</strong> : সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সেতু বিভাগ ও গীতিকার</p> <p> </p>