<p>হংকং একটি ছোট্ট দেশ, যার জনসংখ্যা ৭৩.৫০ লাখ এবং আয়তন এক হাজার ৬৩ বর্গমাইল অর্থাৎ ঢাকা জেলার আয়তনের প্রায় ১.৮৮ গুণ (ঢাকার আয়তন ৫৬৫ বর্গমাইল) আর বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে ৫৩.৬ গুণ ছোট। অথচ হংকংয়ের পার ক্যাপিটা ইনকাম ৬০ হাজার ৫৩০ মার্কিন ডলার। তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হংকং দেশটি। মূল হংকং দ্বীপ, কাউলুন আর নতুন টেরিটরিজ।</p> <p>বাংলাদেশ ১৯৭৬ সাল থেকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে জনশক্তি প্রেরণ করা শুরু করেছে; আর ২০১৭ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত এক কোটি ১১ লাখ কর্মী ১৬২টি দেশে কর্মসংস্থান লাভ করেছে। এ বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত সাত লক্ষাধিক কর্মী বিদেশে কর্মসংস্থান লাভ করেছে। নারী কর্মীদের বিদেশে কর্মসংস্থান মূলত শুরু হয় ১৯৯১ সাল থেকে, তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় যেতে শুরু করে ২০০১ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। তাদের বেশির ভাগই গৃহকর্মে নিয়োজিত হয়; যদিও নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পোশাকশিল্পকর্মী ও অন্যান্য কারখানায় নারী কর্মীরা নিয়োজিত হয়।</p> <p>বহুদিন ধরে নারী কর্মীদের, বিশেষত যারা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে, তাদের জন্য বিকল্প অথবা উন্নত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য ভাবা হচ্ছিল। ২০১২ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে একটি ছোট প্রতিনিধিদল হংকং সফর করে। এ সফরের ব্যয় বহন করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। আমি নিজেও এ দলে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। হংকংয়ে যাওয়ার আগে সেখানে বিদেশি কর্মী নিয়োগসংক্রান্ত তেমন বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। তাদের ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার পর তারা আকৃষ্ট হলো বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে। ২০১৩ থেকে শুরু হলো হংকংয়ে নারী কর্মী নিয়োগ।</p> <p>হংকংয়ে বর্তমানে নারী গৃহকর্মী কাজ করছে প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজার জন। এর মধ্যে ফিলিপিনো এক লাখ ৯০ হাজার, ইন্দোনেশিয়ান এক লাখ ৬০ হাজার, থাই ছয় হাজার, বাংলাদেশি এক হাজার ৩০০ এবং অন্যান্য দেশ থেকে গিয়ে বাকিরা কাজ করছে। কম্বোডিয়া থেকে তারা নতুন করে গৃহকর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৩০০ নারী গৃহকর্মী হংকংয়ে চাকরি লাভ করেছে। আরো প্রায় ৮০০ কর্মী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে, যারা হংকংয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন।</p> <p>হংকংয়ে যাওয়ার জন্য অভিবাসন ব্যয় হিসাবে এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এ অর্থের মধ্যে তাদের যাতায়াত, বহির্গমন ছাড়পত্র, মেডিক্যাল টেস্ট, রিক্রুটিং এজেন্সির ফি, তিন মাসব্যাপী ক্যান্টনিজ ভাষা এবং হংকংয়ের সংস্কৃতি ও আইন-কানুনের ওপর প্রশিক্ষণ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।</p> <p>হংকংয়ের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মী নিয়োগে নিয়োগকর্তাদের আগ্রহ থাকলেও এরই মধ্যে তাদের কিছু নেতিবাচক কার্যক্রম সামগ্রিক সুনাম কিছুটা ক্ষুণ্ন করেছে। বেশ কিছু কর্মী কাজে যোগদানের পর এবং কিছু সেখানে পৌঁছেই কাজ থেকে পালিয়ে গেছে। অনেকে অন্যত্র বেশি বেতনে কাজ ঠিক করেছে, আবার কেউ কেউ ফ্রিল্যান্স কাজ শুরু করেছে। এ জন্য তারা অবৈধ হয়ে পড়েছে। এসব কার্যক্রম তাদের এজেন্সিদের কাছে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে আগ্রহ কমিয়েছে।</p> <p>হংকংয়ের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সঙ্গে আমাদের সভা হয়। সবাই বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিয়োগে আগ্রহী। প্রায় ১০০ মেয়ে কনস্যুলেটে এসেছিল। তাদের জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছে তারা হংকংয়ে। তারা জানায়, বেশ ভালো আছে। যাদের দুই বছর হয়েছে, তারা আট লাখ থেকে ৯ লাখ টাকা দেশে পাঠিয়েছে। বেতন পাচ্ছে মাসে ৪৫ হাজার টাকা। একটি অপূর্ব সুযোগ রয়েছে হংকংয়ে; আর তা হলো যদি কোনো গৃহকর্মী একই মালিকের অধীনে টানা পাঁচ বছর কাজ করে, তাহলে তাকে লং টাইম সার্ভিস বোনাস হিসেবে বেতনের অতিরিক্ত এককালীন এক লাখ ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। যারা এ বোনাস পেয়েছে তারা হৃষ্টচিত্তে তা প্রকাশ করল।</p> <p>অনেক মালিকই গৃহকর্মীর প্রতি নিজের মেয়ের মতো আচরণ করেন। অনেকে আবার চায়নিজ নববর্ষে লাইটি হিসেবে বকশিশ পায়। কোনো কোনো মালিক গৃহকর্মীকে নামাজ পড়ার জন্য উৎসাহিত করে বলেন, ‘প্রার্থনা করলে মানুষ সৎ থাকে।’ কিছু কিছু নেতিবাচক ব্যবহারের নমুনাও পাওয়া যায়। তবে এর সংখ্যা খুবই কম।</p> <p>বর্তমানে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অধীনে চারটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র অর্থাৎ টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও বগুড়ায় হংকংয়ে যাওয়ার জন্য নারী গৃহকর্মীর তিন মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হংকং গমনের জন্য অভিবাসন ব্যয় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়। এ জন্য একজন গ্যারান্টার লাগে। এ অর্থ বেতন থেকে প্রতি মাসে কিস্তিতে পরিশোধ করা যায়। এখন সাতটি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি হংকংয়ে গৃহকর্মী প্রেরণের কাজ করছে। প্রায় দুই হাজার কর্মী এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে কাজে যোগ দিয়েছে প্রায় এক হাজার ৩০০ জন।</p> <p>‘ম্যাকাও’ চীন প্রজাতন্ত্রের আরেকটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল। সেখানেও বাংলাদেশি কর্মীরা পর্যটক ভিসা নিয়ে এসে পরে কর্মসংস্থান ভিসায় রূপান্তর করে। বেশির ভাগ ফিলিপিনো এভাবে এসে কাজ শুরু করেছে। আগামী নভেম্বরে এখানে নতুন আইন প্রবর্তন করতে যাচ্ছে। তাদের এ সুযোগ বিলোপ করা হবে। বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগ করতে রিক্রুটিং এজেন্সিরা খুবই আগ্রহী। মূলত নিরাপত্তা প্রহরী, হসপিটালিটি সেক্টর ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পুরুষ কর্মীর চাহিদা রয়েছে। তাদের বেতন যথাক্রমে ৫০ হাজার ও ৭০ হাজার টাকা।</p> <p>হংকং ও ম্যাকাওয়ে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো কেয়ার গিভার হিসেবে চাকরি। এতে স্বস্তি বেশি, বেতনও বেশি। আবার মূল চীন ভূখণ্ডে গৃহকর্মীর চাহিদা বাড়ছে, যেখানে বেতনমান মাসিক এক লাখ থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর জন্য আরো নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।</p> <p>সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার হংকংয়ে কর্মী প্রেরণের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এ জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বাংলাদেশি কর্মীদের প্রশিক্ষণ আরো সুচারু করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে তাদের কিছু বিশেষ দক্ষতা যেমন—এসি ফিল্টার পরিষ্কার, গাড়ি ধোয়া বা বেসিন পাইপ পরিষ্কারের মতো কাজগুলো শিখে নিলে তাদের চাহিদা যেমন বাড়ত, তেমনি তারা কিছু বাড়তি আয় করতে পারত।</p> <p>বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ যুবশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, যার অর্ধেক নারী। তাদের কর্মসংস্থানের জন্য দেশে পর্যাপ্ত চাকরি সৃষ্টি সম্ভব হয় না। তাই বৈদেশিক কর্মসংস্থানে যথাযথ নিয়োগের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে হংকংয়ের শ্রমবাজারে অধিকসংখ্যক নারী কর্মী প্রেরণ করলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন সম্ভবপর হতে পারে।</p> <p><strong>লেখক : </strong>পরিচালক, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো</p>