<p>ঘুম ভাঙল হাফিজুর রহমান মিতুর ফোন পেয়ে। একজন সমাজসেবী হিসেবে পরিচিত মিতু ১৭ বছর ধরে ইতালিতে থাকে। যার উদ্যোগ ও অর্থায়নে জুরাইনে গড়ে উঠেছে ‘মাল্টিমিডিয়া স্কুল অ্যান্ড স্পোর্টস একাডেমি’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এত ভোরে কণ্ঠ শুনেই বুঝলাম  সে বেশ উত্তেজিত। কুশল জানতে চাইলে তার উত্তর না দিয়ে বলল, সাব্বির ভাই, আমরা কি বাংলাদেশি না! আমরা কি দেশের জন্য কিছুই করছি না! আমার মতো যারা প্রবাসে থেকে দেশে কোটি কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে, তাদের জন্য কি দেশের কোনো দায়িত্ব নেই? আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে বলতে থাকে, ইতালি থাকার কারণে সে সময়মতো ভোটার আইডি কার্ড করতে পারেনি। কিছুদিন আগে সে দেশ থেকে ফিরেছে। এর আগেও দুবার দেশে গিয়েছিল। বিভিন্ন কারণে নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে ভোটার আইডি পেতে ব্যর্থ হয় তখন। খবর নিয়ে জেনেছিল, ছয় মাসের বেশি সময় নাকি লাগে ভোটার আইডি কার্ড পেতে। যেহেতু সে এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশে গিয়েছিল, তাই সে আবারও চেষ্টা করেছিল কার্ডটি পেতে।</p> <p>মা-বাবার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি, বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপি, চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্টের ফটোকপি, দেশত্যাগ ও আবার প্রবেশের সময় পাসপোর্টের যে পাতায় ইমিগ্রেশন সিল মেরেছিল তার ফটোকপি ইত্যাদি কাগজসহ ফরম পূরণ করে নির্বাচন কমিশন অফিসে জমা দিতে গিয়েছিল মিতু। যাওয়ার পর অন্য আরো একটি ফরম দিয়েছিল। এবার বাড়ির খাজনা দেওয়ার রসিদ, স্থানীয় চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলরের ভোটার আইডি কার্ডের নম্বরসহ ফরমের নির্দিষ্ট জায়গায় তাঁদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। এত সব বিড়ম্বনা দেখে ইউরোপের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মিতু মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি। সে দ্বিতীয় ফরমটা টেবিলের ওপর রেখে ভোটার আইডি কার্ডের জন্য আবেদন না করেই ফিরে এসেছে।</p> <p>মিতু ডিজিটাল পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি নাগরিক। জীবিকার প্রয়োজনে বিদেশে থাকে। তার পাসপোর্ট তৈরির সময়ই সরকার উল্লিখিত যাবতীয় তথ্যসহ তার আঙুলের ছাপ নিয়েছে। তাহলে ভোটার আইডি কার্ড করার জন্য বাড়ির খাজনার রসিদ লাগবে কেন! চেয়ারম্যান বা কমিশনারের আইডি কার্ডের সঙ্গে তার কার্ডের সম্পর্ক কী! যে বাড়ির মালিক তাঁর মা-বাবা ভোটার আইডি পেয়েছেন, তাঁদের ছেলে হয়ে তাঁকে কেন বাড়ির খাজনার রসিদ, বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপি দিতে হবে! বিমানবন্দরে নেমে সরকারি আইন অনুযায়ী পাসপোর্টের ফটোকপি দিয়ে মোবাইলের সিম সংগ্রহ করতে হয়, যার মেয়াদ থাকে মাত্র ছয় মাস। ছয় মাসের মধ্যে ভোটার আইডি কার্ড জমা না দিলে ফোনের সিম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ ভোটার আইডি ছয় মাসেও পাওয়া যায় না! কেন এই স্ববিরোধিতা? ভোটার আইডি কি পাসপোর্টের চেয়েও বেশি গ্রহণযোগ্য? প্রবাসী বাংলাদেশিদের কেন এভাবে শাস্তি দেওয়া হয়! ফোন রাখার আগে মিতু শেষ প্রশ্নটি করেছিল, ‘দেশে যদি সব কিছুতেই এত কড়াকড়ি হবে, তাহলে ইতালি থেকে ফোন করলে আমার স্ত্রী তার ফোনে আমার নম্বর না দেখে বাংলাদেশের লোকাল নম্বর কেন দেখতে পায়?’ মিতুর এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে এ ধরনের আচরণে প্রবাসীরা সত্যিই কষ্ট পায়।</p> <p><strong>দুই.</strong></p> <p>২০১০ সালের জুলাই মাস। সুইডেন থেকে দোহা বিমানবন্দরে নেমেছি। বিভিন্ন দেশের প্যাসেঞ্জাররা ট্যাক্স ফ্রি থেকে কেনাকাটা করছিলেন। আমিও দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ চোখ আটকে গেল বেশ দূরে বসা রোগাক্লিষ্ট, মলিন জামাকাপড় পরা, অগোছালো চুল মাথায় নিয়ে বসে থাকা ৩৫-৪০ বছরের একজন মানুষের দিকে। চাকচিক্যে ভরা এয়ারপোর্টের কোনো কিছুর সঙ্গেই যেন তাঁর কোনো সাদৃশ্য ছিল না। অসজ্জিত, জৌলুসহীন জড়তায় যেন লেপ্টে বসে আছেন চেয়ারটার সঙ্গে। দূর থেকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম লোকটিকে। তাঁর চোখের কোনায় যেন ঝুলে আছে এক টুকরো বাংলাদেশ।</p> <p>একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে। লোকটিও তখন আমার দিকে সংকোচে তাকাচ্ছিলেন। তাঁর পাশের সিটে বসে বাংলায়ই জানতে চাইলাম, তিনি বাংলাদেশে যাবেন কি না। উত্তর এলো বাংলায়, ‘জে ভাই, ঢাহা যামু।’ জীর্ণশীর্ণ লোকটির দুই ফিতাওয়ালা স্যান্ডেল পায়ে, গোড়ালির কিছুটা ওপরে উঠিয়ে পরা প্যান্ট, হাফহাতা শার্ট। পকেটে উঁকি দিয়ে বেরিয়েছিল নীল পাসপোর্টের ভেতরে গোঁজা টিকিটের বাড়তি অংশটুকু। পাশেই মেঝেতে রাখা একটা চটের ব্যাগ, যার ওপরে ইংরেজিতে লেখা—‘বেস্ট কোয়ালিটি বাসমতি রাইস’। তাঁর আশপাশে আর কিছুই দেখলাম না। আলাপে জানলাম, তাঁর নাম রমজান আলী, ছুটিতে দেশে যাচ্ছিলেন। বাড়িতে মা, স্ত্রী ও দুই মেয়ে আছে। তাঁর ব্যাগে কী আছে জানতে চাইলে বললেন, ‘ছোট মেয়েটার জন্য পাঁচ কেজি বাসমতি চাল’। আর কিছু নেননি, প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘না স্যার, আর কী নিমু! টেহা যা কামাই, হে তো দেশতই পাডাইয়া দেই। আর হাতে যা থাহে, হেইডা দিয়া কুনো রকম নিজেরই চলতে অয়। তয় এইবার ইচ্ছা কইরাই কিচ্ছু নেই নাইক্কা’, বলেই রমজান আলীর চেহারাটা মলিন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন, আগেরবার তাঁর মায়ের জন্য কম্বল, মেয়ের জন্য চকোলেট আর কিছু কসমেটিকস, বউয়ের জন্য সাজগোজের কিছু উপকরণ নিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা এয়ারপোর্টের কিছু লোক ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে সব কিছু রেখে দেয়। সে জন্য এবার শুধু ছোট মেয়েটার আবদার রাখতে পাঁচ কেজি বাসমতি চাল নিয়েছেন। যথাসময়ে ঢাকার উদ্দেশে প্লেনে উঠে দেখলাম, বেশির ভাগ যাত্রীই আরবের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে আসা বাংলাদেশি শ্রমিক। কয়েক সিট দূরে রমজান আলী বসে আছেন। দুই পায়ের মধ্যে যথারীতি তাঁর বাসমতি চালের ব্যাগটি রাখা। চোখে চোখ পড়তেই তিনি হাত নাড়লেন। আমিও মুচকি হেসে জবাব দিলাম।</p> <p>প্লেন ঢাকায় ল্যান্ড করার পর প্রায় সবাইকেই দেখলাম উত্তেজনায় বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্লেনের দরজা খোলার অপেক্ষায়। দেখলে মনে হবে যেন ১০০ মিটার দৌড়ের হুইসেলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত! দরজা খোলার পর স্রোতের মতো ভিড়ের টানে একসময় নিজেকে আবিষ্কার করলাম প্লেনের বাইরের করিডরে। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে এলাম বেল্ট থেকে লাগেজ সংগ্রহের জন্য। লাগেজ ট্রলিতে উঠিয়ে গ্রিন চ্যানেলের দিকে এগিয়ে যেতেই যে দৃশ্য দেখলাম, তা আমাকে হতবাক করে দিল। স্ক্যানিং মেশিনের সামনে বিরাট জটলা! যাত্রীদের লাগেজ, হাতের ব্যাগ খুলে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে ইউনিফর্ম পরা লোকগুলো। যাত্রীদের চোখেমুখে ভীতির সুস্পষ্ট চিহ্ন। শুনতে পাচ্ছিলাম, এটা-সেটার জন্য ট্যাক্স দিতে হবে। ট্যাক্সের অঙ্ক শুনে অনেকের ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা। কানে আসছিল যাত্রীদের মিনতির শব্দগুলো, ‘ভাই, ছাইড়া দ্যান, পাঁচ বছর-তিন বছর-দুই বছর পর দ্যাশে আইছি। এইডা আমার ব্যবহারের জিনিস। তিন বছরের পুরানা, টিভিডা ভাই সেকেন্ড হ্যান্ড, খুবই কম দাম’ ইত্যাদি। কারবালার প্রান্তরের হাহাকার যেন বিমানবন্দরজুড়ে বিরাজ করছিল। যে উত্ফুল্লতা নিয়ে প্লেন থেকে নেমেছিলাম, তা আর রইল না। বাইরে বেরিয়ে এসে অপেক্ষারত গাড়িতে উঠে বসলাম। কাউকে খোঁজার মতো করে পেছন ফিরে তাকিয়ে খানিকটা দূরে রমজান আলীকে দেখলাম বেরিয়ে আসছেন। তাঁর দুটি হাতই খালি! বাসমতির ব্যাগটা নেই কোনো হাতেই! বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো।</p> <p>ভারতীয়রা প্রবাস থেকে দেশে ফেরার সময় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকে। তারা তিন-ছয় মাস বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরলে ব্যক্তিগত গৃহস্থালিসংক্রান্ত ৬০ হাজার রুপি সমমূল্যের আসবাব শুল্ক না দিয়ে দেশে আনতে পারে। এভাবে এক-দুই বছর হলে দুই লাখ ও দুই বছরের বেশি হলে পাঁচ লাখ রুপির গৃহস্থালিসংক্রান্ত আসবাব শুল্কমুক্তভাবে আনতে পারে। অথচ বাংলাদেশের রমজান আলীরা দেশের জন্য এত করেও সব ধরনের সুবিধা থেকে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে বঞ্চিত হন!</p> <p> </p> <p><strong>লেখক :</strong> সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক</p>