<p>২০১৪ সালের আগস্টে অনুজ এনামুল হক খান এসেছিলেন সুইডেনে। অনলাইনে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও সখ্য হলেও সামনাসামনি সেবারই প্রথম দেখা। শেরপুরের ছেলে এনামুল বর্তমানে ইতালিতে থাকেন। গত বছর তিনি ‘বাঁকা হাওয়া’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণ করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। ইতালিতে ব্যবসার পাশাপাশি অনলাইনে প্রায় ‘ফুলটাইম’ অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে সবাই তাঁকে চেনে। খাবার টেবিলে প্রতিদিন ছুটত আমাদের গল্পের ফোয়ারা। গণজাগরণ মঞ্চের অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে তাঁর বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতার কথা শুনতাম মন দিয়ে। কথা প্রসঙ্গে তাঁকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দীর্ঘদিনের ‘২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনের কথা বলেছিলাম। বিশ্বে বৃহৎ পাঁচটি গণহত্যার কথা বলেছিলাম। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একাত্তরের গণহত্যাটি তার মধ্যে ঘৃণ্যতম। হিরোশিমার পারমাণবিক বোমায় হত্যাকাণ্ডের চেয়েও বাংলাদেশের ঘটিত গণহত্যা ছিল অনেক গুণ বেশি ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী আলফ্রেড কাস্টলার। অথচ আন্তর্জাতিক তো দূরের কথা, অদ্যাবধি বাংলাদেশ সরকারই জাতীয়ভাবে এই গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়নি। এ কথা শোনার পর এনামুল ইস্যুটা নিয়ে অনলাইনে ক্যাম্পেইন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।</p> <p>২০১৫ সালের মার্চের ১ তারিখে এনামুল তাঁর সতীর্থদের উদ্দেশে ফেসবুকে একটা ঘোষণা দিয়েছিলেন এভাবে—‘ভাইলোগ, একটা ভাবনা ও উদ্যোগের চিন্তা আপনাদের মাথায় পুশ করার জন্যই মূলত স্ট্যাটাসটা লিখছি। গত বছর সুইডেনে বেড়াতে গিয়ে সাব্বির খান দাদার কাছে প্রথম জানতে পারি যে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ প্রতিবছর ২৫ মার্চ কালরাত স্মরণে এবং ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালনের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোর মিছিলের আয়োজন করে থাকে। শুনে অপরাধবোধে আড়ষ্ট হয়েছিলাম। বর্তমান প্রজন্মটি মুক্তিযুদ্ধের আবেগ দ্বারা দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ। এটি তত্ত্ব নয়, সত্যিকারের জোয়ারটা আমরা দেখেছিলাম শাহবাগের উত্তাল সময়ে। পরিষ্কার মনে আছে, লাখ লাখ তরুণ মোমবাতি হাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে স্মৃতি কোনো দিনও ভোলার নয়! অথচ প্রজন্মের একজন হয়ে এই আয়োজনের কথা প্রথম জানলাম এত দিন পরে এসে! প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁদের এই ক্ষুদ্র পরিসরের আন্তরিক উদ্যোগে কি আমাদের কিছুই করার নেই? আমরা কি চাইলে পারি না, একটি করে মোমবাতি নিয়ে তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে? শহীদ মিনারকেন্দ্রিক ওই আলোর মিছিলটা সারা বিশ্বে শত গুণ উজ্জ্বলতায় ছড়িয়ে দিতে? এ ব্যাপারে ন্যূনতম তাগিদ কি আমরা নিতে পারি না?’</p> <p>এনামুলের সেই ঘোষণা বোমার মতো আওয়াজ তুলেছিল অনলাইনে। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের দাবিতে ফেসবুকে ‘শুধিতে হবে জন্মের ঋণ’ শিরোনামে একটা ইভেন্ট খোলা হয়েছিল। সেখানে প্রতিদিন দলে দলে বাঙালি এসে জড়ো হতো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ইভেন্টের দায়িত্বে থাকা এনামুল হক খান (ইতালি), নির্ঝর মজুমদার (সুইডেন), সায়দুল ইসলাম (বাহরাইন) ও জুলিয়াস সিজার (সুইডেন) আগতদের অভ্যর্থনা জানিয়ে স্লোগান তুলত। একাত্তরের ভয়াল সেই রাতের কথা লিখে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করত। ভার্চুয়ালজগতে সে এক দেখার মতো দৃশ্য ছিল। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, নির্মূল কমিটির সঙ্গে না থেকেও কত উদার মনে বাঙালিরা একটা জাতীয় ইস্যুতে আত্মনিয়োগ করেছিল। তখন সত্যিকার অর্থেই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের শেষ চিঠির কথাগুলোই যথার্থতা পেয়েছিল, ‘দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারীসমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি, জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। জনগণই সব শক্তির উৎস।’</p> <p>কোনো দাবিতে যখন একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেই আন্দোলনটি যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, তখন সন্দেহাতীতভাবে ধরে নিতে হয়, সেই দাবিটিই মূলত একটি ‘সংগঠন’ এবং নিঃসন্দেহে একটি ‘গণসংগঠন’। সেই অর্থে অনলাইনে তারুণ্যের সংগঠিত ‘২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের’ দাবিটিও রূপ নিয়েছিল একটি সুস্পষ্ট দাবিসংবলিত গণসংগঠনের মতো, যা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর শেষ চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন। সেবারই প্রথমবারের মতো অনলাইন অ্যাকটিভিজম ও প্রচারণার কারণে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, বিশেষ করে এই প্রজন্মের সন্তানরা জানতে পেরেছিল ২৫ মার্চের কালরাতের বিভীষিকার কথা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী হাজার হাজার বাঙালি ছাড়াও অনেক বিদেশি নারগরিকও এই দাবির প্রতি সংহতি জানিয়েছিলেন তখন।</p> <p>২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আলোর মিছিলের ছবি পাঠাতে শুরু করেছিল সবাই। মনে পড়ে পাবনার এক খোলা মাঠে গভীর গর্ত খুঁড়ে কালরাতের মতো করে তৈরি করেছিল বধ্যভূমি। ছবিতে লাশের ওপর লাশ পড়েছিল, ছিন্নভিন্ন পোশাকে রক্তাক্ত দেহ। গর্তের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তরুণ-তরুণীরা জ্বলন্ত মোম হাতে। সৌদি আরব থেকে অন্ধকার ঘরে মোম জ্বালিয়ে টেবিলের চারদিকে গোল হয়ে বসা এক পরিবারের ছবির কথা মনে পড়ে। ইভেন্টের প্রতি সংহতি জানিয়ে ২৫ বছরে প্রথমবারের মতো ‘অনলাইন টেলিভিশন’ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্ব দেখেছিল ঢাকায় নির্মূল কমিটির মশাল প্রজ্বালন। এভাবেই ফেসবুকে ‘শুধিতে হবে জন্মের ঋণ’ ইভেন্টটি ভরে উঠেছিল দাবির প্রতি সংহতি আর শ্রদ্ধায়!</p> <p>গত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার কয়েক দিন আগে এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘যেহেতু ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে শুধু দেশে নয় বিদেশেও পালিত হয়, সুতরাং এই দিবসটি জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি না পাওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ থাকতে পারে না।’ যেহেতু এর আগে বিশ্বব্যাপী কখনোই বৃহদার্থে এই দাবিটি এত আলোড়ন তোলেনি, তাই তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টতই তারুণ্যের অনলাইন ক্যাম্পেইনের ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি দীর্ঘ ২৫ বছর এই দাবির পক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোর মিছিলের আয়োজন করেছে। গত দুই বছর অনলাইনের তরুণ-তরুণীরা সারা বিশ্বের বাঙালিদের জড়ো করেছে এই দাবির পতাকাতলে। এ বছর বাংলাদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস’। কেউ স্মরণ রাখুক বা না রাখুক, ‘ইতিহাস তারুণ্যের এই অবদানের কথা আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে!’ </p> <p> </p> <p><strong>লেখক :</strong> সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক </p>