<p>বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। সাম্প্রতিককালে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। অমঙ্গলের বিপরীতে মঙ্গল, অশুভর বিরুদ্ধে শুভ, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর প্রত্যাশা থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন। ঠিক কবে, কখন, কোথায় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও নগরজীবনে এর প্রচলন হাল আমলের। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলাকে ঘিরেই এর যাত্রা শুরু। চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্ভাবনী ও শিল্পিত কর্মধারা এবং সংস্কৃতিকর্মী, বিশেষ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ চারুকলাকেন্দ্রিক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে শুধু ব্যাপকতাই দেয়নি, শৈল্পিক চরিত্রও প্রদান করেছে।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2016/print-2016/December/04-12-2016/kalerkantho-04-12-2016-24(1).jpg" style="float:left; height:225px; margin:6px 12px; width:342px" />চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের বিশাল আকৃতির মঙ্গল শোভাযাত্রা নানাবিধ উপকরণ, ঢাকঢোল সহকারে চারুকলা থেকে বের হয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এই শোভাযাত্রায় নাটক, যাত্রা, নৃত্যের কস্টিউম পরে সংস্কৃতিকর্মীদের বিপুল অংশগ্রহণ শোভাযাত্রায় ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে। শোভাযাত্রাকে উপলক্ষ করে যুক্ত হয়েছিল আরো দুটি অনুষ্ঠান। আগের দিন বকুলতলায় চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান এবং পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতিপর্ব, যাতে প্রথম দিকে অন্তর্ভুক্ত ছিল যাত্রাপালাও। ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের পর চারুকলায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব মঞ্চ পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। নানা কারণে চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সম্পৃক্ততাও কিছুটা শিথিল হয়ে আসে। ক্রান্তিকালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের সহায়তায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকেও পহেলা বৈশাখ শোভাযাত্রা বের করে। </p> <p>আনন্দের সংবাদ হলো, সম্প্রতি জাতিসংঘের ইউনেসকো পহেলা বৈশাখের এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর মর্যাদা দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ বা মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০০৩ সালে ইউনেসকো একটি সমঝোতা চুক্তি অনুমোদন করে। বাংলাদেশ ২০০৯ সালে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৭০টিরও বেশি রাষ্ট্র এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। নিয়ম অনুযায়ী এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো প্রতিবছর মনোগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের যেকোনো একটি উপাদানকে ইউনেসকোর স্বীকৃতি লাভের জন্য আবেদন করতে পারে। নানা যাচাই-বাছাইয়ের পর ইউনেসকো কোনো সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক প্রস্তাবিত উপাদানকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার ফলে বিশেষ সাংস্কৃতিক উপাদানটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতিই শুধু লাভ করে না, অন্যান্য দেশের মানুষকেও এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। এর আগে বাংলাদেশের ‘বাউলসংগীত’ এবং ‘জামদানি বুননশিল্প’ ইউনেসকো কর্তৃক একই স্বীকৃতি লাভ করে।</p> <p>মঙ্গল শোভাযাত্রার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ নানা কারণে তাত্পর্যপূর্ণ। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই আয়োজনকে বাংলাদেশে একটি বিশেষ মহল নানাভাবে বিরোধিতা করে আসছিল। ধর্মবিরোধী, বিজাতীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি আখ্যায় অভিহিত করে আমাদের এই প্রাণের উৎসব এবং আয়োজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালিয়ে ছিল। মঙ্গল শোভাযাত্রার এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি শুধু অপপ্রচারকেই দূর করবে না, তরুণ প্রজন্মকেও নতুনভাবে উজ্জীবিত করবে। এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়কেও বিবেচনায় আনতে হবে। আমরা সবাই বলি, হাজার বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো লোকজ সংস্কৃতি। সাম্প্রতিককালে আমরা ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি, কোনো কোনো মহল আধুনিকতার নামে, আবার কেউ কেউ বাণিজ্যিক স্বার্থে আমাদের লোক-ঐতিহ্য ও লোক-সংস্কৃতিকে নানাভাবে বিকৃত এবং কলুষিত করছে। আমরা যখন ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা বলি, শিকড়ের সন্ধান করতে চাই, সে সময় এ ধরনের বিনাশী তত্পরতা আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজস্ব ঐতিহ্যকে লালন ও বিকাশের মধ্য দিয়েই আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিনাশী বিদেশি সংস্কৃতির উল্লম্ফন এবং অন্ধ অনুকরণে ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ লাভবান হতে পারেন হয়তো, কিন্তু জাতির গৌরব ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। সচেতন নাগরিক এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সংস্কৃতিকর্মীদের এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ ও কর্মযোগ প্রত্যাশিত।</p> <p>আমরা ইউনেসকোকে ধন্যবাদ জানাব, বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান মঙ্গল শোভাযাত্রাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। একই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-ছাত্রসহ সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী এবং সাধারণ মানুষকে, যাঁরা সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন ও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঐতিহ্যে পরিণত করায় সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। জয় হোক সংস্কৃতির। জয় হোক মানুষের।</p> <p><strong>লেখক :</strong> সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব</p>