<p>স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে ও পরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কয়েক হাজার বছরের। কিন রাজবংশের শাসনামল (খ্রিস্টপূর্ব ২২১-২০৬ সাল) থেকেই চীনা ভিক্ষু, পণ্ডিত ও ব্যবসায়ীরা অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাংলায় ঘন ঘন যাতায়াত করেছেন মর্মে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। চায়নিজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, যে দুজন বিখ্যাত চায়নিজ পরিব্রাজক প্রাচীন বাংলায় ভ্রমণ করেছেন তাঁরা হলেন Yijing ও Xuanzang। অন্যদিকে বাংলায় পাল বংশের শাসনকালে বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে গমন করে সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সুদীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের পারদে নাটকীয় ওঠানামা ঘটেছে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। চল্লিশের দশকের শেষ বছরে সংঘটিত চীনা বিপ্লবের অব্যবহিত পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এক নতুন রূপ নেয়। এ সম্পর্ক রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল না; এটা ছিল আদর্শিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের শিকড়সূত্রে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই একাধিকবার বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সফর করেছেন। স্বাধীনতার আগে থেকেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে, বিশেষ করে মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। চীন-বাংলা সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে কেন্দ্র করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ এশিয়ায় জটিল ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চীন পাকিস্তানের পক্ষে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে নানা কারণে চীনের বৈরী সম্পর্ক এবং ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে চীনের তিক্ততা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল। এ অবস্থায় সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিলে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার পক্ষে থাকা একমাত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে বলে অনেকে মনে করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর বহু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য পদপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে চীন ১৯৭৪ সাল অবধি বিরোধিতা করেছে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৯৭৫ সালের শেষে ও ১৯৭৬ সালের শুরুতে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের যে ভিত্তি রচিত হয়েছিল তার প্রধান অবলম্বন ছিল নিরাপত্তা ইস্যু। সেদিক থেকে এ সম্পর্ক সামরিক-রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ ছিল। ফলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের প্রাথমিক সূত্র তৈরি হয় অস্ত্র সরবরাহের মধ্য দিয়ে।</p> <p>নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির বদৌলতে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন প্রীতির এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক সামরিক-রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে বাণিজ্যিক সম্পৃক্ততা, সফট লোন, সামাজিক যোগোযোগ, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিনিময় এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়েছে। ‘সিল্ক রোড’ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চীন দুই দেশের মধ্যে এ সম্পর্ক আরো জোরালো করতে চায়। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করতে চীন বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি Asia-Pacific Trade Agreement (APTA)-এর আওতায় চার হাজার ৭৮৮টি বাংলাদেশি পণ্যকে তার বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্য বিস্তৃতীকরণের উদ্দেশ্যে চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, চট্টগ্রাম থেকে কুনমিং পর্যন্ত ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়ক নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা শুধু সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত চীনের পূর্ব উপকূলের সমুদ্রপথের সীমাবদ্ধতা দূর করবে না, উপরন্তু পণ্য পরিবহন খরচও কমাবে। বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে চট্টগ্রামে চীনের জন্য একক অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ। চীন বাংলাদেশের আমন্ত্রণে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংস্থা সার্কের পর্যবেক্ষক হয়েছে। সামরিক সম্পর্কের সূত্র ধরে সম্পর্কের সূচনা হলেও চীন ক্রমেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে এক বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সামরিক ও আর্থবাণিজ্যিক স্বার্থের বাইরে অন্য দিক থেকেও চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক চর্চা করেছে। বিশেষত মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বিষয়ের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।</p> <p>চীন-বাংলাদেশ মৈত্রীর এ ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ ২৫টি বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে ২০.০৯৯ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিয়েছে। ম্যাজিক অর্থনীতির বাংলাদেশ বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের এ কাঙ্ক্ষিত যাত্রায় মূলধন ও কারিগরি সহযোগিতার চায়নিজ বন্ধুত্ব সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে নতুন মাত্রা যোগ করবে সন্দেহ নেই।</p> <p>চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের সম্পর্কে প্রীতির পাশাপাশি কিছু ভীতির বিষয় রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কথায় আছে, ‘বড়র পিরিতি বালির বাঁধ’। চীন দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আর ক্রয়ক্ষমতার তুলনামূলক হিসাব বা পিপিপির বিবেচনায় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি। অন্যদিকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্যম আয়ের দেশের তকমা লাগানোর জন্য উঁকিঝুঁকি মারছে শুধু। আকাশপাতাল ব্যবধানের অর্থনীতির দুই দেশের অসম প্রেমের মধ্যে নানাজন নানা অর্থ খুঁজে বেড়ান। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর থেকে চীনের সঙ্গে ভারতের অস্বস্তিকর সম্পর্ক কয়েক দশক ধরে। তারই রেশ ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে পেইচিংয়ের সামরিক সহযোগিতা নিয়ে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষুব্ধ। সাম্প্রতিককালে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়েও ভারত উদ্বিগ্ন। ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে যে চীন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে দিয়ে ভারতকে ঘিরে রাখতে চায়। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে বন্দর বানিয়ে ভারত মহাসাগরে চীনের কথিত ‘মুক্তার মালায়’ অন্তর্ভুক্তি নিয়েও ভারত উদ্বিগ্ন। ভারতের যুক্তি হলো, এ অঞ্চলে এর মধ্যেই তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দর চীনা অর্থে ও চীনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত ও পরিচালিত হচ্ছে। এ তিনটি সমুদ্রবন্দর হলো, শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা ও কলম্বোয় দুটি এবং পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দর। ভারতের আশঙ্কা, চীন বাংলাদেশেও গভীর সমুদ্রবন্দর বানিয়ে চীনের কথিত ‘মুক্তার মালা’ সমুদ্রনীতি বাস্তবায়ন করবে। চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশে অ্যান্টি-শিপ মিসাইল লঞ্চিং প্যাড স্থাপন ও চীনের সামরিক কর্মকর্তার উপস্থিতিতে মিসাইল নিক্ষেপের সফল পরীক্ষা চালানো এবং চীনের কাছ থেকে দুটি ডিজেলচালিত সাবমেরিন ক্রয় নিয়েও ভারত উদ্বিগ্ন। ভারতীয় সামরিক পরিকল্পনাবিদদের শঙ্কা, চীন বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশকে তার যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনগুলোর ডক হিসেবে ব্যবহার করার আদর্শ স্থান মনে করতে পারে। এ উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় নৌবাহিনী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে সাগরদ্বীপে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাটারি ও রাডার পর্যবেক্ষণ স্থাপন করেছে। এদিকে সমুদ্রে চীনা বাড়বাড়ন্ত ঠেকানোর জন্য প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়াতে ভারত ও আমেরিকা সম্প্রতি যে চুক্তি করেছে, তাতে মেরামতি ও রসদ সরবরাহসংক্রান্ত কারণে দুই দেশ পরস্পরের ভূমি, আকাশ ও নৌঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। চুক্তি সম্পাদনের আগে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে, চীনা ড্রাগনকে ঠেকাতে তারা ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরো গভীর করতে চায়। প্রতিরক্ষা চুক্তি ছাড়াও ভারত ‘চীন ঠেকাও’ নীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত জোটে যোগ দিয়েছে। দুই দলের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যেমন নিরীহ মানুষ ক্রসফায়ারের শিকার হয়ে থাকে, তেমনি চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের বিবাদে নিরীহ বাংলাদেশের ক্রসফায়ার ভিকটিম হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।</p> <p>চীনের বাংলাদেশপ্রীতি নিয়ে বাংলাদেশের ভীতির কারণ না থাকলেও উদ্বেগের কারণ রয়েছে। কয়েক হাজার বাংলাদেশি পণ্যের চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের পরও বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫.৮৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার, ২০১৪ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬.৮০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। আর গত অর্থবছর এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭.৪৩ বিলিয়ন ইউএস ডলারে। চীন যেখানে প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন ইউএস ডলারের সমপরিমাণ পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে, সেখানে গত অর্থবছরে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল অতি নগণ্য—মাত্র ৭৯১ মিলিয়ন ইউএস ডলার।</p> <p>আমাদের উন্নয়নে, দারিদ্র্য দূরীকরণে, অর্থনৈতিক ভিত্তি আরো শক্তিশালীকরণে, সর্বোপরি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে চীন ও ভারত উভয়ের সহযোগিতাই দরকার। কিন্তু বাংলাদেশ-চীন-ভারত ত্রয়ী সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক কূটনীতির ঝুঁকি নেওয়া কোনোভাবেই উচিত হবে না। বরং দুই বৃহৎ রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের তরফ থেকে এ বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও উন্নয়ন পররাষ্ট্রনীতি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের এ পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলা বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। চীন, ভারতসহ পৃথিবীর সব রাষ্ট্রকে বার্তা দিতে হবে যে এক সাগর রক্ত ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে কেনা বাংলাদেশের জল, স্থল ও আকাশসীমা কারো সামরিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে না। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও ভারতের আগ্রহ রয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বাংলাদেশ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এদের নিয়ে কনসোর্টিয়াম গঠন করতে পারে। ভারতকে অনুধাবন করতে হবে, বাংলাদেশের সামরিকনীতি আগ্রাসী নয়, আত্মরক্ষামূলক। বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্র এলাকা ও এর সম্পদভাণ্ডার রক্ষা, আহরণ ও উন্নয়ন করতে সাবমেরিন, জাহাজসহ অন্যান্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি অত্যাবশ্যক। চীনের সামরিক সরঞ্জামের বড় ক্রেতা শুধু বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিসর, নাইজেরিয়া ও সুদানও বটে। ভারতের উত্কণ্ঠা হ্রাসে ও এ অঞ্চলের শান্তি-স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে গঠিত অর্থনৈতিক করিডর বিসিআইএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এ তিনটি উদীয়মান ব্লকের কেন্দ্রবিন্দুরূপে আবির্ভূত হতে পারে এ করিডর। বিসিআইএম-কে কার্যকর ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী ইন্দো-চীন উত্তেজনা প্রশমনে ও চীনের সঙ্গে পানিবণ্টন চুক্তিতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারে। আর ইন্দো-চীন সুসম্পর্ক ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা হ্রাসে টনিকের মতো কাজ করবে। চীন ও সম্মিলিত দক্ষিণ এশিয়া জোটবদ্ধ হলে আগামী কয়েক শতাব্দীর সভ্যতার ধারক-বাহক ও রচয়িতা হবে চীন ও দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ-আমেরিকা নয়।</p> <p>চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া, অংশীদারি, বিশ্বাস, স্বচ্ছতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে একে লালন করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে চীন-বাংলাদেশ প্রীতি স্মৃতিতে পরিণত হতে বাধ্য। এক আমেরিকানের চায়নিজ বন্ধু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে আমেরিকান বন্ধু চায়নিজ বন্ধুকে হাসপাতালে দেখতে যায়। হাসপাতালে শয্যার পাশে আমেরিকান বন্ধু দাঁড়ানোর পর চায়নিজ বন্ধু ‘নি চাদোয়ান লা উয়াদা ইয়াংজি গুয়ান’ বলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আমেরিকান বন্ধু চায়নিজ ভাষা জানত না। মৃত্যুর আগে বন্ধু তাকে কী বলেছে, তা জানার জন্য আমেরিকান বন্ধুটি আরেকজন চায়নিজের শরণাপন্ন হলে চায়নিজ ব্যক্তিটি তাকে জানায়, এর অর্থ হলো, ‘বন্ধু, যে অক্সিজেন পাইপ দিয়ে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস সচল রাখা হয়েছে, তুমি তার ওপর দাঁড়িয়ে আছ, আমি মরে যাচ্ছি।’ চীন বা বাংলাদেশ নিজেরা বা অন্য কেউ বন্ধুত্বের অক্সিজেন পাইপের ওপর দাঁড়িয়ে যাতে বন্ধুত্বের মৃত্যু ঘটাতে না পারে সে জন্য দুই দেশকেই সতর্ক থাকতে হবে।</p> <p> </p> <p> </p> <p>লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>zhossain@justice.com</p> <p> </p>